পুষ্টি খাতে বিপুল ব্যয়ের পরও উন্নতি সামান্য

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি সরকারের আরও ১২টি মন্ত্রণালয় নিয়মিতভাবে দেশের মানুষের পুষ্টির উন্নতিতে টাকা খরচ করছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সরকার ১৩টি মন্ত্রণালয়কে পুষ্টির জন্য বিভিন্ন প্রকল্পে ২৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। এর মধ্যে খরচ হয় ২৩ হাজার ২১০ কোটি টাকা। তবে পুষ্টি খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হলেও এর ফলাফল সন্তোষজনক নয়।

সর্বশেষ ২০১৪ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ অনুযায়ী, দেশে অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর হার এখনো অনেক বেশি। দেশের ৫ বছরের কম বয়সী ৩৬ শতাংশ শিশুর উচ্চতা ও ৩৩ শতাংশ শিশুর ওজন বয়সের তুলনায় কম। অন্যদিকে কম ওজন নিয়ে জন্মানো শিশুর হার বাড়ছে। জন্মের পর প্রথম ৬ মাস শুধু বুকের দুধ খায় মাত্র ৫৫ শতাংশ শিশু। ২২ শতাংশ কিশোরীর উচ্চতা কম। এ ছাড়া নারীদের মধ্যে রক্তস্বল্পতার হারও অনেক বেশি।

পুষ্টিবিদেরা বলছেন, পুষ্টির বিনিয়োগ সঠিক জায়গায় হতে হবে। অর্থ ব্যয় করলেই পুষ্টির উন্নতি হবে না।

পুষ্টিতে সরকারি ব্যয় নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদ ও ইউনিসেফের করা একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদন গত সপ্তাহে প্রকাশ করা হয়। এই প্রতিবেদন তৈরিতে কারিগরি সহায়তা দেয় অক্সফোর্ড পলিসি ম্যানেজমেন্ট নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। পর্যালোচনায় ২০১৪–১৫ থেকে ২০১৬–১৭—এই তিন অর্থবছরের পুষ্টি খাতে সরকারি ব্যয় এবং ২০১৭–১৮ অর্থবছরে বাজেট বরাদ্দ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই পর্যালোচনার উদ্দেশ্য ছিল পুষ্টি খাতে সরকারি অর্থায়ন ব্যবস্থাপনার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বিশ্লেষণ করা।

বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের মহাপরিচালক মো. শাহনেওয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, ভাবা হতো পুষ্টি খাতে টাকা নেই, টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় না। এই দাবি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। ২০১৬–১৭ অর্থবছরে ২৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। সঠিক জায়গায় অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে কি না, সে ব্যাপারে তদারকি ও নজরদারি বাড়ানোর সময় এসেছে। তিনি বলেন, এই প্রতিবেদন নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে পরামর্শ করার উদ্যোগ নেবে পুষ্টি পরিষদ।

পুষ্টিতে কোথায় কত ব্যয়

২০১৬-১৭ অর্থবছরে সরকারের দেওয়া বরাদ্দের ৮০ শতাংশ ব্যয় করেছে ৪টি মন্ত্রণালয়—খাদ্য, স্বাস্থ্য, প্রাথমিক শিক্ষা এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এই চারটিসহ ১৩টি মন্ত্রণালয় প্রায় ২৯১টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ২০টি প্রকল্পে খরচ হয়েছে প্রায় ৮১ শতাংশ টাকা।

মো. শাহনেওয়াজ বলেন, মাত্র ২ শতাংশ অর্থ খরচ হতে দেখা গেছে সুনির্দিষ্ট বা প্রত্যক্ষ পুষ্টিবিষয়ক কাজে। যেমন নারীকে আয়রন বড়ি দেওয়ার মতো সরাসরি পুষ্টির কাজে বরাদ্দ ও ব্যয় কম। কিন্তু কেনাকাটায় ব্যয় অনেক বেশি।

পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পুষ্টি খাতে বড় অঙ্কের টাকা দেয় দাতারা। এনজিওগুলো এই টাকা নিয়ে পুষ্টির উন্নয়নে কাজ করে। এ রকম প্রায় ৬০টি প্রকল্পের সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে এনজিওগুলো তিন বছরে (২০১৪–১৫ অর্থবছর থেকে পরবর্তী তিন বছরে) ৬ হাজার ১৮২ কোটি টাকা ব্যয় করেছে।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে পুষ্টি খাতে ৩৪ শতাংশ ব্যয় করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যয় দেখা গেছে গম ও চাল কেনার ক্ষেত্রে। এরপর বেশি ব্যয় করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়। পুষ্টি খাতে মোট ব্যয়ের ২৬ শতাংশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। পুষ্টি খাতে ১৩ ও ৭ শতাংশ ব্যয় করেছে যথাক্রমে প্রাথমিক শিক্ষা ও গণশিক্ষা এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। বাকি ২০ শতাংশ ব্যয় করেছে অন্য ৯টি মন্ত্রণালয়।

ব্যয় পর্যালোচনায় দেখানো হয়েছে, মাত্র ২ শতাংশ ব্যয় হয়েছে প্রত্যক্ষ পুষ্টিসংশ্লিষ্ট কাজে (তেল পুষ্টিসমৃদ্ধ করা বা লবণে আয়োডিন মেশানো)। বাকি ৯৮ শতাংশ ব্যয় হয়েছে পরোক্ষ কাজে (একটি বাড়ি একটি খামার, ভিজিএফ কর্মসূচি)।

পুষ্টিবিদ এস কে রায় প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় বাজেটের ৯ শতাংশ পুষ্টির জন্য খরচ হয়, এই হিসাব দিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনো সুযোগ নেই। দুঃখজনক হচ্ছে, সরাসরি অপুষ্টি দূর করতে মাত্র ২ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে। জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে দরিদ্র অংশে অপুষ্টি বেশি, সুতরাং অর্থায়নের সময় তাদের গুরুত্ব দিতে হবে। খাদ্যে বৈচিত্র্য আনলে অপুষ্টি দূর হবে।