'পারলে খুনিদের ছবি তোলেন'

বুয়েটে নিহত আবরার ফাহাদের মায়ের আহাজারি। গতকাল সকালে কুষ্টিয়া শহরের পিটিআই সড়কের বাড়ি।  ছবি: প্রথম আলো
বুয়েটে নিহত আবরার ফাহাদের মায়ের আহাজারি। গতকাল সকালে কুষ্টিয়া শহরের পিটিআই সড়কের বাড়ি। ছবি: প্রথম আলো

গণমাধ্যমের কর্মীরা সকাল থেকেই আসছিলেন আবরারদের বাড়িতে। অনেকে ছবি নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। আবরারের মা রোকেয়া খাতুন তখন তাঁদের বলেন, ‘আমার ছবি নিয়ে কী করবেন? পারলে যারা আমার ছেলেকে খুন করেছে, তাদের খুঁজে বের করেন। তাদের ছবি তোলেন। পারবে প্রশাসন আমার বাবুকে আমার বুকে ফিরিয়ে দিতে?’

আত্মীয়স্বজন ঘিরে রেখেছিলেন রোকেয়া খাতুনকে। কিন্তু সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনো কথা আসছিল না কারও মুখেই। আকস্মিক এই মর্মান্তিক মৃত্যুসংবাদে আবরারের পরিবার বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। স্বজনেরা শোকে স্তব্ধ। আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ সকালেই ঢাকায় গেছেন ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে।

গতকাল সোমবার সকাল ১০টায় আবরারের কুষ্টিয়া শহরের পিটিআই সড়কের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পরিবারের সদস্যরা শোকে মুহ্যমান। তাঁরা বুঝে উঠতে পারছেন না এত মেধাবী, শান্ত ছেলেটিকে কারা হত্যা করতে পারে!

কান্নাজড়িত কণ্ঠে আবরারের মা বলেন, কোন অপরাধে তাঁর ছেলেকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো? তিনি পুত্র হত্যার বিচার চেয়ে বলেন, সরকার কি পারবে খুনিদের ফাঁসি দিতে? তিনি বলেন, ‘গতকাল (রোববার) সকালে আমি আমার বাবুকে নিজে মুখে তুলে খাইয়েছি। এক সঙ্গে বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে বাসে তুলে দিয়েছি। পথের মাঝে থেকে তিন-চারবার ফোনে আমার সঙ্গে কথা বলেছে। বিকেল পাঁচটায় হলে পৌঁছে আমাকে ফোন দিয়ে বলেছে, “মা, আমি হলে পৌঁছে গেছি। ” পরে রাতে অনেকবার ফোন দিয়েছি। কিন্তু সে আর ফোন ধরেনি। আজ সকাল শুনতে পেলাম সেই ছেলে আমার খুন হয়ে গেছে।’ কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন রোকেয়া খাতুন।

পরিবারের সদস্যরা জানান, আবরার ফাহাদ ও তাঁর ছোট ভাই ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী আবরার ফায়াজ গত ২৮ সেপ্টেম্বর ছুটিতে বাড়িতে এসেছিলেন। এ মাসের ২০ তারিখ পর্যন্ত বাড়িতে থাকার ইচ্ছা ছিল তাঁদের। তবে সামনে পরীক্ষা, তাই প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য আবরার ফাহাদ গত রোববার সকালেই ঢাকায় চলে যান। সদ্য পুত্রহারা আবরারের মা সেই কথা বলছিলেন বারবার।

আবরারের চাচা মিজানুর রহমান বলেন ‘এখন অনেকেই রটাচ্ছে, আবরার শিবিরের কর্মী। কিন্তু এটা বানোয়াট, আমরা সবাই আওয়ামী লীগের সমর্থক। হানিফ সাহেবের বিভিন্ন মিটিংয়েও আমরা যাই।’

আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের নিরীক্ষক কর্মকর্তা ছিলেন। বর্তমানে এলাকায় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার নিরীক্ষক। মা রোকেয়া খাতুন একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষক। দুই ভাইয়ের মধ্যে আবরার ফাহাদ বড়। ছোট ভাই আবরার ফায়াজ ঢাকা কলেজের উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। সে ঢাকা কলেজের হোস্টেলে থাকে। বুয়েটের শেরেবাংলা হলের কাছেই তার হোস্টেল।

পরিবারের সদস্যরা জানান, আবরার ফাহাদের কোনো শত্রু ছিল না। তাঁদের পুরো পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সমর্থক। তাঁদের সন্তানকে কেন এভাবে জীবন দিতে হলো, বুঝে উঠতে পারছেন না পরিবারের সদস্যরা।

আবরারকে খুন করা হয়েছে, এটা মেনে নিতে পারছেন না তাঁর একসময়ের সহপাঠীরাও। প্রাথমিকে কুষ্টিয়া মিশন স্কুল ও মাধ্যমিকে কুষ্টিয়া জিলা স্কুলের ছাত্র ছিলেন আবরার। এই দুই সময়েই আবরারের বন্ধু প্রিন্স মারিফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবরার খুবই সহজ-সরল ছিল। একটু উচ্চ স্বরে কথা বললে কেঁদে দিত।’

কুষ্টিয়া জিলা স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এফতে খাইরুল ইসলাম বলেন, ‘ফাহাদ মেধাবী ও শান্ত ছেলে ছিল। তার ভাই ফায়াজও মেধাবী। এ রকম শান্ত প্রকৃতির ছেলেকে মেরে ফেলা হবে, ভাবতেই পারছি না।’

আবরার ফাহাদের দাদাবাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার রায়ডাঙ্গা গ্রামের চিত্রও একই। আবরার হত্যার ঘটনার পর দাদা আবদুল গফুর বিশ্বাসের বাড়িতে এলাকার মানুষ জড়ো হয়েছেন। বেলা তিনটায় সেখানে গিয়ে দেখা গেল, অশীতিপর গফুর বিশ্বাস বাড়ির উঠানে পায়চারি করছেন। তিনি জানেন নাতি দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে। তাঁকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

আবদুল গফুর বিশ্বাস আওয়ামী লীগের কট্টর কর্মী। বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও এখনো নৌকায় ভোট দিয়ে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে বাড়ি ফেরেন। তাঁর ছেলে ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ বিশ্বাসও আওয়ামী লীগের সমর্থক।

আবরারের দাদাবাড়ির সামনে কথা হয় কয়া ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি ও রায়ডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা আনিচুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বহুত আগে থেকে আবরারের দাদা আওয়ামী লীগের কট্টর কর্মী। আবরারের বাবাও আওয়ামী লীগের সমর্থক। এই পরিবার গ্রামের সবচেয়ে শিক্ষিত ও ঐতিহ্যিক পরিবার। আবরার ভদ্র ছেলে ছিল। তাকে এভাবে হত্যা করা মেনে নেওয়া যায় না।’

আবরার ফাহাদের লাশ রাতে কুষ্টিয়ায় পৌঁছানোর কথা রয়েছে। মঙ্গলবার সকালে রায়ডাঙ্গা গ্রামে লাশ দাফন করা হবে বলে পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে।

মানববন্ধন: আবরার হত্যার প্রতিবাদে গতকাল বিকেলে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়ক অবরোধ করেন ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা। আজ মঙ্গলবার সকালে কুষ্টিয়া জিলা স্কুলের সামনে স্কুলের প্রাক্তন ছাত্ররা বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন করবেন।