ভারতের চাওয়াই অগ্রাধিকার পেল

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফলকালে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেন। ছবি: পিআইডি
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফলকালে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেন। ছবি: পিআইডি

ভারতের আসাম রাজ্যের নাগরিক তালিকা (এনআরসি) নিয়ে বাংলাদেশের অস্বস্তি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে দূর হয়নি। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির বিষয়টি এ সফরেও শুধু আশ্বাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে পণ্য পরিবহন, সমুদ্র উপকূলে নজরদারির জন্য রাডার স্থাপন এবং ত্রিপুরার জনগণের জন্য ফেনী নদীর পানি নেওয়া—ভারতের অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলো চূড়ান্ত হয়েছে।

ভারতের সঙ্গে দর–কষাকষির ক্ষেত্রে যে প্রস্তুতি বাংলাদেশের প্রয়োজন, তাতে ঘাটতি আছে বলে মনে করেন সাবেক কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষকেরা। তাঁরা বলছেন, ভারত আগের মতোই বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করতেই বেশি মনোযোগী, জনগণের সঙ্গে নয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দিনের সফরে ৩ অক্টোবর দিল্লি যান। এ সফরে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেন। এ ছাড়া রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।

৫ অক্টোবর দিল্লিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতি প্রচার করা হয়। এ বিবৃতির প্রসঙ্গ টেনে ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ফেনী নদী থেকে ভারতের ত্রিপুরার সাবরুমের জন্য প্রতিদিন ১ দশমিক ৮ কিউসেক পানি সরবরাহ ও ত্রিপুরায় তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলপিজি) রপ্তানির মতো বিষয়গুলোতেও ভারতের অনুরোধে বাংলাদেশ উদারভাবে সাড়া দিয়েছে। এ ছাড়া ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চল থেকে পণ্য পরিবহনের জন্য চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর বিষয়ে মানসম্মত কার্যপ্রণালি বিধি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর–এসওপি) এবং সামুদ্রিক নিরাপত্তার অংশীদারত্বের অংশ হিসেবে উপকূলে নজরদারির জন্য রাডার স্থাপনের জন্য সমঝোতা স্মারক সই করেছে বাংলাদেশ।

প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশে নিবন্ধিত ট্রাকে করে আখাউড়া হয়ে ভারতের ত্রিপুরার বিশালগড়ে ইন্ডিয়ান অয়েলের বোতলজাত কেন্দ্রে গ্যাস রপ্তানি করা হবে। এতে করে মাত্র ২০০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে ত্রিপুরায় জ্বালানি পরিবহন নিশ্চিত করা যাবে। ভারতের অন্য অঞ্চল থেকে ত্রিপুরায় এলপিজি পাঠাতে দেড় হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিতে হয়। এ বছরের আগস্টে পরীক্ষামূলকভাবে ত্রিপুরায় বোতলে করে এলপিজি পাঠানো হয়। পুরোদমে গ্যাস পাঠানো শুরু হলে মোংলার এলপিজি টার্মিনাল ও ঘোড়াশালের এলপিজি বোতলজাত কেন্দ্র থেকে ট্রাকে করে তা ত্রিপুরায় পরিবহন করা হবে। বাংলাদেশ থেকে ত্রিপুরায় এলপিজি আমদানির বিষয়ে ২০১৭ সালের আগস্টে একটি চিঠি পাঠায় ভারত। ওমেরা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড, বেক্সিমকো এলপিজি ইউনিট-১–কে ত্রিপুরায় এলপিজি পাঠানোর অনুমোদন দেওয়া হয়।

দিল্লির কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, দুই দেশের আনুষ্ঠানিক বৈঠকের পরপরই ৫ অক্টোবর নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আরেকটি বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে আসামের নাগরিক তালিকা (এনআরসি), কাশ্মীরের সর্বশেষ পরিস্থিতি এবং ভারতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্ক ও অশুল্ক বাধা বিলোপের প্রসঙ্গগুলো তোলেন তিনি। এনআরসি প্রসঙ্গে মোদি বলেন, বিষয়টি ভারতের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া, এটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। এ বিষয়ে তিনি নানা ব্যাখ্যা তুলে ধরেন।

ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপের মধ্য দিয়ে কাশ্মীরের পরিস্থিতিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে বিবৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ। এই বিবৃতি প্রকারান্তরে নরেন্দ্র মোদির সরকারের পক্ষেই গেছে বলে মনে করেন সাবেক কূটনীতিকেরা। কাশ্মীর বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থানের বিষয়টি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, দেশটির রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে আলোচনাতেও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

পানিবণ্টনে সহযোগিতা

বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের একাধিক সদস্য এ প্রতিবেদককে বলেন, ফেনী, মনু, মুহুরী, খোয়াই, গোমতী, ধরলা ও দুধকুমোর—এই সাতটি নদ–নদীর অন্তর্বর্তীকালীন রূপরেখা চুক্তি সইয়ের জন্য তিন মাসের একটি সময়সীমা নির্ধারণ করতে চেয়েছিল ভারত। কিন্তু নির্ধারিত এই সময়ের মধ্যে চুক্তি চূড়ান্ত করার কাজ শেষ না হলে সমালোচনার মুখে পড়তে হবে—এ বিবেচনায় বাংলাদেশ কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা রাখতে চায়নি। ফলে যৌথ ঘোষণায় নির্দিষ্ট সময়ের পরিবর্তে দ্রুততম সময়ের মধ্যে রূপরেখা চুক্তি চূড়ান্ত করার কথা উল্লেখ আছে।

ঢাকার কূটনীতিকেরা বলছেন, তিস্তা চুক্তিতে তেমন কোনো অগ্রগতি হবে না, এ নিয়ে দিল্লি যাওয়ার আগেই বাংলাদেশের মানসিক প্রস্তুতি ছিল। তাই তিস্তায় আটকে না থেকে অভিন্ন অন্য নদীগুলো নিয়ে আলোচনা এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি গঙ্গা ব্যারাজের সমীক্ষার কাজে অগ্রগতিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রায় এক দশকের বিরতির পর এ বছরের শেষ দিকে যৌথ নদী কমিশনের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক হবে। ওই বৈঠকে নদীর পানি নিয়ে কিছু অগ্রগতি হতে পারে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ঐতিহাসিকভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের কংগ্রেস পার্টির নিবিড় সম্পর্ক আছে। বিজেপির সঙ্গে সম্পর্কটা তেমন ঘনিষ্ঠ নয়। কাজেই ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির মতো একটি আদর্শিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে পরিশীলিতভাবে যে প্রস্তুতি দরকার, সেটা বাংলাদেশ নেয়নি। তিনি বলেন, ভারত নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আছে। বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে একটি দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কের ব্যাপারে ভারতের রাজনীতিবিদদের দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হবে।