স্বামীর মুখে ভয়ংকর সেই রাতের কথা

নোয়াখালীর সুবর্ণচরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রাতে স্বামী-সন্তানকে বেঁধে রেখে চার সন্তানের জননীকে (৪০) গণধর্ষণের মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ ও জেরা শুরু হয়েছে। গতকাল বুধবার নোয়াখালীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২-এর বিচারক জেলা জজ মোহাম্মদ সামস্উদদীন খালেদের আদালতে প্রথম দিন বাদীর সাক্ষ্য গ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়েছে।

মামলার বাদী ধর্ষণের শিকার নারীর স্বামী। বুধবার দুপুর ১২টায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়ে চলে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। মাঝখানে ৪৫ মিনিটের বিরতি দেওয়া হয়। আদালতে বাদীর সাক্ষ্য গ্রহণ চলাকালে আসামির কাঠগড়ায় ধর্ষণের ঘটনার প্রধান ইন্ধনদাতা বহিষ্কৃত আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিনসহ ১৩ জন এবং কাঠগড়ার বাইরে জামিনে থাকা ১ জন আসামি উপস্থিত ছিলেন। এ সময় আদালতের বারান্দায় আসামিদের স্বজন ও উৎসুক মানুষের ভিড় লক্ষ করা গেছে।

দুপুর ১২টায় সাক্ষ্য গ্রহণের শুরুতে মামলার বাদী কাঠগড়ায় থাকা আসামিদের শনাক্ত করেন। এরপর তিনি বিগত ৩০ ডিসেম্বর দিবাগত রাতের পুরো ঘটনার বর্ণনা করেন। বাদী উল্লেখ করেন, সেই দিন রাতের খাবার খেয়ে তাঁরা স্বামী-স্ত্রী চার ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। রাত সাড়ে ১২টার দিকে আসামিদের একজন ঘরের দরজায় এসে তাঁর নাম ধরে ডাকাডাকি করেন। এ সময় ঘুম থেকে ওঠে তাঁর স্ত্রী ঘরের দরজা খুলে দেন।

বাদী বলেন, দরজা খুলে দেওয়ার পরই আসামিরা সবাই ঘরে ঢুকে পড়েন। কয়েকজন তাঁকে ও ছেলেমেয়েদের বেঁধে ফেলেন। আর কয়েকজন তাঁর স্ত্রীকে টেনেহিঁচড়ে ঘরের বাইরে নিয়ে যান। সেখানে একজনের পর একজন ধর্ষণ এবং মারধর করেন। প্রায় দুই-আড়াই ঘণ্টা পর আসামিরা বাড়ি থেকে চলে যান। যাওয়ার সময় বসতঘরের বেড়ায় কুপিয়ে ক্ষতবিক্ষত করেন।

বাদী উল্লেখ করেন, আসামিরা চলে যাওয়ার পর তিনি অনেক চেষ্টা করে হাতের বাঁধন খোলেন। পরে তিনি ছেলেমেয়েদের বাঁধনও খুলে দেন। এরপর প্রথমে তিনি, পরে পেছন পেছন ছেলেমেয়েরা ঘরের বাইরে গিয়ে তাঁর স্ত্রীকে বিবস্ত্র অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকতে দেখেন। এ সময় চিৎকার দিলে প্রতিবেশী দুই নারী জোলেখা ও লায়লা এগিয়ে আসেন। তাঁদের সহযোগিতায় স্ত্রীকে অচেতন অবস্থায় ঘরে নেন।

ধর্ষণের শিকার নারীর স্বামী আদালতকে বলেন, আসামিদের মারধরে তাঁর স্ত্রীর ডান হাত ভেঙে যায়। শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্ত বের হতে থাকে। রাতেই তিনি নির্যাতনের শিকার স্ত্রীকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য মোছলে উদ্দিন ও তারিম নামের দুই অটোরিকশাচালককে খবর দেন। কিন্তু আসামি বেচু, বুলু, রুহুল আমিন, চৌধুরী অটোরিকশা আসতে বাধা দেন।

বাদী আদালতকে জানান, পরে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে অ্যাম্বুলেন্সযোগে তাঁর স্ত্রীকে সদর হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করেন। সেখানে চিকিৎসায় স্ত্রী কিছুটা সুস্থ হলে তাঁর কাছ থেকে ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনা শুনে আসামিদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন। থানায় তিনি সব আসামির নাম বলেছেন। পুলিশ বলেছে, বর্ণনা অনুযায়ী সব লেখা হয়েছে। পড়ালেখা না জানায় তিনি পড়ে দেখতে পারেননি।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি ছিলেন মামুনুর রশীদ লাভলু। তাঁকে সহায়তা করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোল্লা হাবিবুর রছুল মামুন, আবদুর রহমান, রবিউল হাসান পলাশ প্রমুখ। অপরদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী ছিলেন হারুনুর রশীদ হাওলাদার, আবুল হোসেন রাজু, বোরহান উদ্দিন মোহন প্রমুখ। এর মধ্যে পলাতক দুই আসামির পক্ষে ‘স্টেট ডিফেন্স’-এর দায়িত্ব পালন করেন আইনজীবী আবুল হোসেন। ১৩ অক্টোবর মামলার পরবর্তী সাক্ষ্য নেওয়া হবে।

গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর রাতে স্বামী-সন্তানদের বেঁধে রেখে এক নারীকে (৪০) মারধর ও গণধর্ষণ করা হয়।

নির্যাতিত নারীর অভিযোগ ছিল, ভোটকেন্দ্রে থাকা ব্যক্তিদের পছন্দের প্রতীকে ভোট না দেওয়ার জের ধরে ওই হামলা ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় ১৬ জনের বিরুদ্ধে গত ২৭ মার্চ আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)।