'এমন নৃশংস ভাই আমরা বুয়েটে চাই না'

‘আবরার কারও সঙ্গে একটা টুঁ–শব্দও করতে জানত না। কোনো ঝামেলায় সে কখনোই যেত না, কারও কাছ থেকে কোনো কথা শুনলেও প্রতিবাদ করত না, ছিল অসম্ভব মেধাবী। আবরার তার বন্ধুদের সব সময় ভালো পরামর্শ দিত, খারাপ কাজে নিরুৎসাহিত করত। এমন একটা ছেলেকে এভাবে কেউ মারতে পারে। এমন নৃশংস ভাই আমরা বুয়েটে চাই না।’

আবরার ফাহাদ। ফাইল ছবি
আবরার ফাহাদ। ফাইল ছবি

বৃহস্পতিবার দুপুরে বুয়েট শহীদ মিনার এলাকায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সমাবেশের সামনে এসব কথা বলছিলেন নিহত বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদের বন্ধু ইমামুল হাসান। এসব বলতে বলতে তাঁর চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু অশ্রু জমে। দুঃসহ স্মৃতির কাফনে মোড়া সেই অশ্রু গাল বেয়ে পড়েনি, তবে বিষাদে ছেয়ে যায় তাঁর হৃদয়। আশপাশের পরিবেশও হয়ে ওঠে ভারী।

আবরারের সঙ্গে কুষ্টিয়ার স্কুল, ঢাকার নটর ডেম কলেজ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন ইমামুল হাসান। বলেন, ‘সেদিন সকালে আমি ঘুমাচ্ছিলাম। এক বন্ধু ফোন করে আমাকে আবরারের হত্যার ঘটনাটা জানাল। একটু পরে জানতে পারলাম, ঘটনা সত্য। খবর শোনার পর মুখটা পর্যন্ত ধুইনি, ওই অবস্থাতেই এখানে চলে এসেছি। কিন্তু হলে গিয়ে দেখলাম, আবরার সেখানে নেই। পরে ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে ওর কয়েকজন আত্মীয়কে দেখলাম। তাঁরা জানালেন, লাশ মর্গে রাখা হয়েছে। পরে যখন মর্গের রুমে গিয়ে লাশটার দিকে তাকালাম, আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি। এমন একটা ছেলেকে এভাবে কেউ মারতে পারে।’

বুয়েটের দ্বিতীয় বর্ষের এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘আবরারকে কখনো কোনো অন্যায় করতে দেখিনি। তাকে কেউ কীভাবে এতটা নৃশংসভাবে মারতে পারে। আমি ভাবতে পারিনি, এটা আমার বুয়েটের কোনো ভাইয়ের কাজ হতে পারে। আমার বুয়েটের ভাইয়েরাই আরেক ভাইকে মেরেছে, নিজেকে কীভাবে সান্ত্বনা দেব। নিজের ভাইকে কেউ কীভাবে এভাবে পিটিয়ে মারতে পারে।’

নিজের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়–জীবনের বন্ধুর স্মৃতিচারণা করে ইমামুল বলেন, ‘আবরার সব সময়ই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত, আমাদেরও নামাজ পড়তে বলত। এটা নতুন কিছু না। স্কুল-কলেজে থাকতে যখনই আমরা কোনো অন্যায় কাজে তাকে নিতে চেয়েছি, সে যায়নি, সরে গেছে। সে আমাদের বোঝাত—খারাপ কাজ করা উচিত না। সে ছিল আমাদের অভিভাবকের মতো। আমার ফ্রেন্ড সার্কেলের মধ্যে যাদের সঙ্গে থেকে আমি উপকৃত হয়েছি, আবরারের নাম তাদের মধ্যে ওপরের দিকে থাকবে। সে সব সময় ভালো পরামর্শ দিত, খারাপ কাজে নিরুৎসাহিত করত। এমন নিরপরাধ একটা ছেলেকে আমরা হারিয়েছি।’

গত রোববার রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কিছু নেতার নির্মম মারধরে আবরার ফাহাদ নিহত হন। আবরার ঠিক কতটা ভালো ছেলে ছিলেন, তা ভাষায় সংজ্ঞায়িত করাও সম্ভব নয় বলেও মন্তব্য করেন বন্ধু ইমামুল হাসান। হত্যার বিচারসহ বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশে তিনি বলেন, ‘আবরার একই সঙ্গে বুয়েট, ঢাকা মেডিকেল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিল। ফলে তার মেধা সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। কিন্তু সে যে কতটা ভালো ছিল, এটা ভাষায় সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয়। আমি নিজের সম্পর্কে দ্বিধাহীনভাবে কিছু বলতে পারব না, কিন্তু আবরার ফাহাদ সম্পর্কে নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারব, এমন ভালো ছেলে আর হয় না। তার বাবা ও মায়ের মুখে বয়সের যে ছাপ পড়েছে, তা তার জন্যই। সে ছিল তাঁদের কাছে হীরার টুকরার মতো। তার পুরো পরিবারটা শেষ হয়ে গেল।’

বিক্ষোভ সমাবেশে আবরারের স্মৃতিচারণা করে আরও বক্তব্য দেন কলেজজীবন থেকে আবরারের সহপাঠী ও বর্তমানে বুয়েটে দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত আশকার রহমান। তিন বলেন, ‘আবরারের হত্যাকাণ্ডের খবরটা শোনার পর থেকে তিনটা দিন ঘুমাতে পারিনি। ঘুমাতে গেলেই ওর লাশের ছবিটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এত ভালো একটা ছেলেকে কেউ কীভাবে মারতে পারে।’

এদিকে আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে দিনের কর্মসূচি সমাপ্ত ঘোষণা করেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। উপাচার্য গত মঙ্গলবার তাঁদের সঙ্গে দেখা করলেও পরে তাঁর আর দেখা পাননি তাঁরা। কাল শুক্রবার দুপুরের মধ্যে বুয়েট উপাচার্য সাইফুল ইসলাম আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের কাছে না এলে বুয়েটের সব ভবনে তালা ঝোলানোর ঘোষণা দিয়েছেন তাঁরা।