বুয়েটের 'নির্লিপ্ত' উপাচার্য

বুয়েটের উপাচার্য সাইফুল ইসলাম
বুয়েটের উপাচার্য সাইফুল ইসলাম

বুয়েটের উপাচার্য সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিষয়ে ‘নির্লিপ্ততার’ অভিযোগ পুরোনো। নিয়মানুযায়ী উপাচার্যদের সার্বক্ষণিক ক্যাম্পাসে থাকতে হয়। এ জন্য বাংলোও আছে। কিন্তু উপাচার্য সেখানে থাকেন না। ক্যাম্পাসে আসেন দুপুরে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজ ঠিকমতো হয় না।

বুয়েটের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে উপাচার্যের বিষয়ে এমন তথ্য জানা গেছে। বুয়েট শিক্ষক সমিতির একাধিক সভার কার্যবিবরণীতেও উপাচার্যের ‘নির্লিপ্ততার’ কথা রয়েছে। সর্বশেষ আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার পর উপাচার্যের নির্লিপ্ততার চূড়ান্ত রূপ প্রকাশ পেয়েছে। ফলে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি এখন জোরালোভাবে উঠেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, আবাসিক হলগুলোতে দিনের পর দিন র‍্যাগিং এবং বিভিন্ন ঠুনকো অজুহাতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন হলেও এসব বন্ধে বুয়েট প্রশাসন কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বুয়েটের উপাচার্য হিসেবে যোগ দেন ২০১৬ সালের জুনে। তাঁর শিক্ষকতা যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন নেই। তাঁর পিএইচডি ডিগ্রি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কিন্তু প্রশাসক হিসেবে তাঁর যোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তাঁর জন্য আলাদা বাংলো থাকলেও তিনি থাকেন লালবাগ এলাকায়। গতকাল দুপুরে ক্যাম্পাসে উপাচার্যের বাংলোয় গেলে দায়িত্বরত দারোয়ান জানান, উপাচার্য বাসায় নেই। এখানে তিনি থাকেন না। মাঝেমধ্যে আসেন।

একজন শিক্ষক ও দুজন কর্মচারী বলেন, উপাচার্য প্রায় প্রতিদিন দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ১টার দিকে ক্যাম্পাসের কার্যালয়ে আসেন। রাতেও অফিস করেন। অথচ বুয়েটের অফিস সময় সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা।

গত ১৩ জুলাই বুয়েট শিক্ষক সমিতির সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়, বর্তমান উপাচার্য দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর থেকেই এক এক করে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐহিত্যবিরোধী কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছেন। উপাচার্য অফিসে বেশির ভাগ ফাইল সিদ্ধান্তহীনতার অভাবে পড়ে থাকে। ফলে রেজিস্ট্রার অফিসসহ অন্যান্য অফিসের কাজেও স্থবিরতা চলে আসছে। বিভিন্ন একাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজের প্রয়োজনে নিয়মিত একাডেমিক কাউন্সিল, সিলেকশন বোর্ড ও সিন্ডিকেটের সভা হচ্ছে না। প্রশাসনিক অদক্ষতার কারণে উপাচার্যের মেয়াদকালে আনুমানিক সাড়ে ২৪ কোটি টাকা যথাসময়ে উন্নয়নকাজে ব্যয় করতে ব্যর্থ হওয়ায় তা সরকারি কোষাগারে ফেরত গেছে।

বুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি এ কে এম মাসুদ প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ঠিকমতো চলছে না। জ্যেষ্ঠ শিক্ষকেরাও সহজে উপাচার্যের সাক্ষাৎ পান না। তিনি গত তিন বছরে অন্তত ২২ বার বিদেশ গেছেন। তাঁর অদক্ষতা ও নির্লিপ্ততায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষতি হচ্ছে, এ জন্য তাঁর পদত্যাগ চেয়েছে শিক্ষক সমিতি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমানের বক্তব্যেও বুয়েট প্রশাসনের কাজে দীর্ঘসূত্রতার বিষয়টি জানা যায়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি তিন বছরের কিছু বেশি সময় হয়েছে দায়িত্ব নিয়েছেন। এই সময়ে তিনটি র‍্যাগিংয়ের ঘটনায় হল পর্যায়ে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার পর অধিকতর তদন্তের জন্য আরও বেশ কিছুদিন আগে উপাচার্যের কাছে পাঠানো হয়েছে, কিন্তু এখনো তদন্ত কমিটি হয়নি।

একাধিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৈরি করা একটি সার্ভারে ১০৩টি অভিযোগ জমা পড়লেও সেগুলোর বিষয়ে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বুয়েট প্রশাসন।

গত রোববার বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের (১৭ তম ব্যাচ) ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করেন বুয়েট ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী। এ ঘটনার পর উপাচার্যের অদক্ষতার বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক হলেও ঘটনা জানার দুই দিন পরও ঘটনাস্থলে হাজির হননি তিনি। এমনকি বুয়েট ক্যাম্পাসে আবরারের জানাজায়ও অংশ নেননি। হত্যাকাণ্ডে জড়িত হিসেবে চিহ্নিত ১৯ ছাত্রের (সবাই ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী) বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থাও নেননি।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, যেখানে উপাচার্যের বাসা আছে, তাঁকে তো ক্যাম্পাসেই থাকতে হয়। তিনি একাডেমিশিয়ান হিসেবে হয়তো ভালো। কিন্তু সংকট মোকাবিলা করার মতো সাহস তাঁর হয়তো নেই। তিনি বোধ হয় এ ঘটনার (আবরার হত্যা) ভয়াবহতা ও গভীরতা সম্পর্কে সম্যক অনুধাবন করতে পারেননি। এ জন্য একজন উপাচার্যকে শিক্ষাগত বিষয়ে দক্ষ হওয়ার পাশাপাশি সংকট মোকাবিলা করার মতো দক্ষতাও থাকতে হবে।