মানব পাচারে অর্ধশত দালাল

সিলেটে মানব পাচারে অর্ধশত দালাল সক্রিয়। তাঁরা অবৈধ ট্রাভেল ব্যবসায়ী এবং বিদেশে থাকা মানব পাচারকারীদের মাধ্যমে কমিশন বা মাসোহারার ভিত্তিতে নিযুক্ত। দালালদের কাজ নানাভাবে ফুসলিয়ে স্থানীয় তরুণ-যুবকদের অবৈধ পথে বিদেশে যেতে রাজি করানো। এরপর ট্রাভেল ব্যবসায়ী ও মানব পাচারকারীদের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হয়।

দালালদের প্রলোভনে পড়ে তরুণ-যুবকেরা যে পথে পা বাড়াচ্ছেন, তা অনিশ্চয়তায় ভরা। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে কেউ কেউ গন্তব্যে পৌঁছান। অন্যদের সামনে পথ খোলা দুটি—মাঝপথে মৃত্যুকে আলিঙ্গন, না হয় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে নিঃস্ব হয়ে দেশে ফেরা।

গত পাঁচ মাসে অবৈধ পথে বিদেশযাত্রার পর সিলেটের ২২ জনের মৃত্যুর ঘটনার প্রেক্ষাপটে এক অনুসন্ধানে এসব তথ্য পেয়েছে প্রথম আলো। প্রশাসনের কর্মকর্তা, ট্রাভেল ব্যবসায়ী ও সচেতন নাগরিকেরা বলছেন, যাঁরা এভাবে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, তাঁরাও পদে পদে অনিশ্চয়তা ও মৃত্যুঝুঁকির বিষয়টি জানেন। এরপরও লোভে পড়ে তাঁরা এই পথে পা বাড়াচ্ছেন।

জানতে চাইলে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘অবৈধ ট্রাভেল ব্যবসায়ী ও দালালদের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসন নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন মানব পাচারে সম্পৃক্ত দালালদের তৎপরতা অনেক কম। এরপরও পুরো বিষয়টি আমাদের কড়া নজরদারির মধ্যে থাকবে।’

স্থানীয় প্রশাসন ও ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিলেট জেলাজুড়ে অর্ধশতাধিক দালাল মানব পাচারে সক্রিয়। তাঁদের নিয়োগ দিয়েছেন নগরের অবৈধ ট্রাভেল ব্যবসায়ী এবং দেশের বাইরে অবস্থান নিয়ে মানব পাচারে যুক্ত কিছু ব্যক্তি। তাঁদের কাছ থেকে কমিশন কিংবা মাসোহারা পেয়ে থাকেন ওই দালালেরা। তাঁরা প্রথমে স্থানীয় তরুণ-যুবকদের ইউরোপের উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখান। এমন নানা প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে অবৈধ পথে বিদেশযাত্রায় রাজি করান। রাজি হওয়া ব্যক্তিরা ৮-১০ লাখ টাকায় দালালের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন।

ঝুঁকিপূর্ণ পথে বিদেশযাত্রার বিষয়ে ধারণা আছে এমন কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সিলেট অঞ্চলের অবৈধ ট্রাভেল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে অবস্থানরত বাংলাদেশি কিংবা সেখানকার কিছু অসাধু ব্যক্তির যোগসাজশ রয়েছে। বিদেশে অবস্থানরত সেই ব্যক্তিদের মাধ্যমেই দেশ থেকে তরুণ-যুবকদের অবৈধ পথে কাঙ্ক্ষিত দেশে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়। যাত্রার পথটা অনেক দীর্ঘ, সময়সাপেক্ষ ও কষ্টসাধ্য। এদেশ–ওদেশ ঘুরিয়ে গন্তব্যের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। যাত্রাপথে দিনের পর দিন অর্ধাহারে কিংবা অনাহারে থাকতে হয়। ঝুঁকি নিয়ে চলতে হয় সমুদ্রপথে কিংবা হেঁটে। সামনে মৃত্যুঝুঁকি থাকলেও আর পেছানোর সুযোগ থাকে না।

গত ৯ ও ১০ মে লিবিয়া থেকে নৌকায় করে বিপজ্জনকভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে যাওয়ার চেষ্টা করেন একদল ব্যক্তি। পথে নৌকাডুবিতে তাঁদের ইউরোপ-স্বপ্নের সলিলসমাধি ঘটে। ওই দলে থাকা সিলেটের ২০ যুবকও নিহত হয়েছিলেন। গত ২৩ আগস্ট অবৈধ পথে গ্রিস থেকে সড়কপথে ইতালিতে যাওয়ার সময় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান সিলেট সদর উপজেলার পাগইল গ্রামের শাহীন আহমদ। সর্বশেষ ৯ সেপ্টেম্বর মারা যান সিলেটের বিশ্বনাথের যুবক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। তিনি রাশিয়া থেকে ইউক্রেন হয়ে অবৈধভাবে ফ্রান্সে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।

ফরিদের শ্বশুর মো. আফাজ উদ্দিন জানান, ২০১৮ সালে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখতে রাশিয়ায় গিয়েছিলেন ফরিদ। খেলা শেষ হওয়ার মাসখানেক পর তিনি রাশিয়া থেকে ইউক্রেনে যান। সেখানে দীর্ঘদিন অবৈধ অভিবাসী হিসেবে ছিলেন। সম্প্রতি ইউক্রেন থেকে ফ্রান্সে যাওয়ার জন্য রাশিয়ায় অবস্থানরত ‘দাদা’ নামে পরিচিত এক দালালের সঙ্গে চুক্তি করেন। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশে লিটনের এজেন্ট বিয়ানীবাজার উপজেলার ‘কামাল’ নামের এক দালালের কাছে ৫ লাখ ২২ হাজার টাকা জমা দেয় ফরিদের পরিবার। টাকা পাওয়ার পর দালালেরা আরও পাঁচজনের সঙ্গে ফরিদকে ঝুঁকিপূর্ণ পথে তুলে দেন। ছয়জনের দলটি গত ২৮ আগস্ট হেঁটে দুর্গম জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ফ্রান্সের দিকে রওনা দেয়। অন্য পাঁচজন ফ্রান্সে পৌঁছালেও স্লোভাকিয়ার ওই জঙ্গলের ভেতরে মারা যান ফরিদ। ওই পাঁচজনের একজন সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার বাসিন্দা। বাকিরা হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার।

অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) সিলেট শাখা জানিয়েছে, বিভাগের চার জেলায় নিবন্ধিত ২০০ ট্রাভেল এজেন্সি রয়েছে। এর বাইরে রয়েছে আরও প্রায় পাঁচ শ অবৈধ ট্রাভেল এজেন্সি। মূলত এসব অনিবন্ধিত এজেন্সিই অবৈধ পথে মানব পাচারে জড়িত। ২০১৮ সালের ২ এপ্রিল সংগঠনটির পক্ষ থেকে এমন ৭৪টি ট্রাভেল এজেন্সির তালিকা জেলা প্রশাসনকে দেওয়া হয়েছিল। তখন জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে মাত্র এক দিন অভিযান হয়েছিল। অবশ্য গত মে মাসে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির ঘটনার পর জেলা প্রশাসন ব্যাপকভাবে অভিযান পরিচালনা করেছে। ওই ঘটনায় প্রাণ হারানো সিলেটের ২০ জনই এখানকার বিভিন্ন অবৈধ ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন।

আটাব বলছে, অবৈধ পথে বিদেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে বিয়ানীবাজারের দালালদের আধিক্য সবচেয়ে বেশি। এই উপজেলায় ৩০ থেকে ৪০ জন দালাল রয়েছেন। এ ছাড়া জেলার বিশ্বনাথ ও সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলায় ৫ থেকে ১০ জন করে দালাল রয়েছেন। সিলেটের অন্যান্য উপজেলাতেও ১ থেকে ৩ জন দালাল রয়েছেন। আর নগরের ৮ থেকে ১০টি ট্রাভেল এজেন্সি সরাসরি মানব পাচারে যুক্ত।

আটাব সিলেটের সভাপতি মো. আবদুল জব্বার জলিল প্রথম আলোকে বলেন, ‘নানা সময়ে অবৈধ ট্রাভেল ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীরা আমাদের কাছে অভিযোগ করে থাকেন। তবে বিদেশ গমন–ইচ্ছুকদের আরও সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। বৈধ ট্রাভেল ব্যবসায়ী ছাড়া অন্য কারও মাধ্যমে বিদেশে যাওয়া যাবে না। অন্যদিকে স্থানীয় প্রশাসনকেও অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ পথে মানব পাচার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।’

সিলেট জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মানব পাচার রোধে পুলিশ তৎপর রয়েছে। তারপরও বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটছে। গ্রামপর্যায়ে দালালদের তৎপরতা খোঁজ নিয়ে দেখা হবে। সত্যতা পাওয়া গেলে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।