যুবলীগের 'ট্রাইব্যুনাল' শুধু নামেই

ওমর ফারুক চৌধুরী
ওমর ফারুক চৌধুরী

যত অপকর্মই করুক না কেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা না পড়া পর্যন্ত দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না যুবলীগ। এটাই যেন নীতি যুবলীগে। একক ক্ষমতার অধিকারী সংগঠনের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর কারণে অন্য কারও কিছু করার নেই।

সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, দলের নেতা-কর্মীদের অপরাধের বিচার করতে ‘ট্রাইব্যুনালের’ বিধান রয়েছে যুবলীগের। তবে যুবলীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা প্রথম আলোকে বলেন, সংগঠনের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর মুখের কথাই যুবলীগে আইন। তিনি মুখে মুখে পদ দেন, অনেক সময় নানা চাপে পড়ে কারও পদ কেড়েও নেন। আবার সময় বুঝে ওই পদ ফিরিয়ে দেন। তবে এসব মৌখিক সিদ্ধান্তের কোনো নথি থাকে না সংগঠনের কেন্দ্রীয় দপ্তরে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষোভ প্রকাশ করার পরও ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাটকে বহিষ্কার করতে তিন সপ্তাহ অপেক্ষা করেছে সংগঠনটি। অভিযুক্ত এমন অনেক নেতাকে বহিষ্কার করতেও সংগঠনের নীতিনির্ধারকেরা গ্রেপ্তার হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছেন।

যুবলীগের দুজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, ক্যাসিনো, টেন্ডার, চাঁদাবাজিতে কেন্দ্রীয় ও মহানগর কমিটির নেতাদের মতো যুবলীগের ওয়ার্ড কমিটির অনেক নেতাও নানা অপকর্মে যুক্ত। তাঁদের অপকর্মের খবর শীর্ষ নেতাদের কাছে আছে। অনেকেই টাকার বিনিময়ে পদ কিনেছেন যুবলীগে। তাঁরা তো অপকর্ম করবেনই। আবার তাঁদের অপকর্ম থেকে আয়ের ভাগ যায় শীর্ষ নেতাদের পকেটে। তাই অপকর্ম জানা থাকলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

বহিষ্কারের জন্য গ্রেপ্তার পর্যন্ত অপেক্ষার বিষয়ে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ বলেন, আত্মগোপনে থাকায় আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া যায়নি। তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটকের পর বহিষ্কার করা হচ্ছে। এটি সংগঠনের নীতিগত সিদ্ধান্ত।

বহিষ্কারের পর মৌখিকভাবে পদ ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে হারুনুর রশীদ বলেন, মৌখিকভাবে করা না হলে ভালো হতো। সংগঠনে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার ঘাটতি ছিল। ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিশ্চয়ই এসব ত্রুটি দূর করবে।

>

অভিযুক্তদের অপকর্ম জেনেও চুপ থাকেন কেন্দ্রীয় নেতারা
গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত বহিষ্কার করা হয় না
আত্মগোপনে থেকেও পদে বহাল অনেকে।

যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির পাঁচজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অভিযান শুরুর পর প্রতিদিন গণমাধ্যমে বিভিন্ন নেতার অপকর্মের তথ্য উঠে আসছে। ক্যাসিনো, টেন্ডার, চাঁদাবাজি করে বিত্তবৈভব গড়া যুবলীগের অনেক নেতা এখন গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে আছেন। কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। পিয়ন থেকে যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক হয়ে বিত্তবৈভব বানানো কাজী আনিসুর রহমান আত্মগোপনে চলে যাওয়ার প্রায় তিন সপ্তাহ পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে গতকাল শুক্রবার তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। ক্যাসিনো–কাণ্ডে অভিযুক্ত মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সহসভাপতি সোহরাব হোসেন ওরফে স্বপন, সরোয়ার হোসেন ওরফে মনা, যুগ্ম সম্পাদক এ কে এম মমিনুল হক ওরফে সাঈদও পালিয়ে আছেন। এঁদের কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি যুবলীগ।

চলমান অভিযান শুরুর দুই দিনের মাথায় গত ২০ সেপ্টেম্বর বিকেলে রাজধানীর উত্তরা-আজমপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে যুবলীগের চেয়ারম্যান বলেন, ‘ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে যাকে ধরা হবে, তাকেই সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হবে।’ যদিও এর আগে গত ১৮ সেপ্টেম্বর মতিঝিল ও আরামবাগ এলাকার ক্লাবপাড়ায় ক্যাসিনোতে অভিযান শুরুর দিনে যুবলীগের চেয়ারম্যান মিরপুরের দারুস সালাম এলাকার গোলারটেক মাঠে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদ্দেশে বলেন, ‘এখন কেন অ্যারেস্ট হবে? এখন হঠাৎ করে কেন জেগে উঠলেন? কারণটা কী? এটা কি বিরাজনৈতিকীকরণের দিকে আসছেন?’

যুবলীগের দপ্তর সূত্র জানায়, চলমান অভিযানের আগে ২০ জনের মতো নেতাকে বিভিন্ন সময় বহিষ্কার করেছে যুবলীগ। কিন্তু তাঁরা প্রায় সবাই কিছুদিন পর আবার যুবলীগে সক্রিয় হন। সংগঠনের নিয়মিত বৈঠক, জনসভা—সবকিছুতেই অংশ নিতেন, এমনকি বিভিন্ন সভায় বক্তব্যও দিতেন। সংগঠনকে ব্যবহার করে অর্থ উপার্জনের অভিযোগ আছে যুবলীগের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধেও। ইতিমধ্যে ওমর ফারুকের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সরকারের অনুমতি ছাড়া তিনি দেশত্যাগ করতে পারবেন না। অভিবাসন পুলিশের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা গত রোববার রাতে প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

সংগঠন সূত্রে জানা গেছে, কৃষিজমি দখল করে শিল্প স্থাপন নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে বহিষ্কৃত হন যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আতিয়ার রহমান। ২০১৬ সালের আগস্টে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। এর আগে ২০১৫ সালের জুলাইয়ে বহিষ্কৃত হন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম। রাজধানী সুপারমার্কেটে র‍্যাবের অভিযানে আটক হওয়ায় ওই সময় তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নিজের ছবি কৃত্রিমভাবে জুড়ে দেওয়ায় বহিষ্কৃত হয়েছিলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাকসুদুর রহমান। তাঁদের তিনজনের সঙ্গেই কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন তিনজনেই।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, সংগঠনের গঠনতন্ত্র কেউ কখনো তোয়াক্কা করেছে বলে মনে হয় না। প্রতিটি কাজ নেতাদের খেয়ালখুশি, ইচ্ছা অনুযায়ী হয়। বহিষ্কার ও প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে সেটাই প্রতিফলিত হয়।