'মিজান মাদকের গডফাদার'

হাবিবুর রহমান ওরফে মিজান। প্রথম আলো ফাইল ছবি
হাবিবুর রহমান ওরফে মিজান। প্রথম আলো ফাইল ছবি

ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান ওরফে মিজান একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ ও অবৈধ মাদক কারবারিদের গডফাদার। তিনি পেশিশক্তি খাটিয়ে দীর্ঘদিন বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিলেন।

ঢাকা মহানগর উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় করা মামলায় এসব অভিযোগ তুলেছে র‍্যাব। গত শনিবার র‍্যাবের ওয়ারেন্ট অফিসার সাজিত মিয়া বাদী হয়ে মানি লন্ডারিং আইনে এই মামলা করেন।

মামলায় বলা হয়, হাবিবুর রহমান অবৈধ অস্ত্র দেখিয়ে ভীতি সৃষ্টি করে টেন্ডারবাজি, গরুর হাট দখল এবং চাঁদাবাজি করে স্বনামে-বেনামে বিপুল অর্থ–বৈভবের মালিক হয়েছেন। র‍্যাবের দাবি তাদের জিজ্ঞাসাবাদে হাবিবুর জানিয়েছেন, ঢাকা জেলার সাভার থানায় তাঁর বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা রয়েছে। ২০১৬ সালের ২৭ নভেম্বর তাঁর বিরুদ্ধে ওই হত্যা মামলা করা হয়। এ ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় আরও মামলা ও সাধারণ ডায়েরি (জিডি) রয়েছে বলেও জিজ্ঞাসাবাদে র‍্যাবের কাছে স্বীকার করেন তিনি।

গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাবিবুর রহমানকে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের কলেজ গেটের একটি বাসা থেকে ২ লাখ টাকা, চারটি গুলিভর্তি একটি পিস্তলসহ আটক করে র‍্যাব। পরে তাঁকে ঢাকায় এনে শুক্রবার বিকেলে মোহাম্মদপুরের আওরঙ্গজেব রোডে তাঁর নিজের ফ্ল্যাটে তল্লাশি চালান র‍্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। তল্লাশির পর ভ্রাম্যমাণ আদালত জানান, হাবিবুরের বাসা থেকে ১ কোটি টাকার স্থায়ী আমানত (এফডিআর) এবং ৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকার বিভিন্ন ব্যাংকের সই করা চেক পাওয়া যায়। হাবিবুর ব্যাংক থেকে ৬৮ লাখ টাকা তুলেছেন, এমন তথ্যও পায় র‍্যাব। ওই ঘটনায় র‍্যাব বাদী হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় হাবিবুরের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ এবং শ্রীমঙ্গল থানায় অস্ত্র আইনে পৃথক আরেকটি মামলা করে। হাবিবুর মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।

মানি লন্ডারিং আইনের মামলায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ঢাকা মহানগর শাখা হাবিবুরকে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। গতকাল ছিল তাঁর রিমান্ডের প্রথম দিন। মামলা তদন্ত তদারকের সঙ্গে যুক্ত সিআইডির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর কাছে থাকা অর্থের উৎস সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

গতকাল রোববার সরেজমিনে শ্যামলী, মোহাম্মদপুরের আওরঙ্গজেব রোড, জেনেভা ক্যাম্প ও আশপাশের অন্তত ১৫ জন বাসিন্দা এবং এই এলাকার একাধিক পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁরা জানান, কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মাদক কারবার, জমি দখল থেকে থেকে শুরু করে খুনখারাবি পর্যন্ত বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন।

জেনেভা ক্যাম্পের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন বাসিন্দা অভিযোগ করেন, হাবিবুর মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে (আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ক্যাম্প) মাদক ও চোরাই গ্যাস-বিদ্যুতের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করতেন। ক্যাম্পের বিদ্যুৎ লাইন থেকে ক্যাম্প লাগোয়া কাঁচাবাজার ও মাছের বাজারের তিন শতাধিক দোকানে অবৈধ সংযোগ দিয়ে মাসে ৫ লাখ চাঁদা তুলতেন। তাঁর সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তাদের সখ্য থাকায় বারবার অপরাধ করেও তিনি পার পেয়ে যান। তাঁর বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস পেতেন না। এখনো স্থানীয় বাসিন্দারা প্রকাশ্যে তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন।

হাবিবুর ২০১৪ সালে মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আহমেদ ওরফে পাইন ও তাঁর অসুস্থ স্ত্রী মরিয়ম বেগমকে তুচ্ছ ঘটনায় অনেক মানুষের সামনে জুতাপেটা করেন।

পুলিশ জানায়, গত বছর জমি দখল ঘিরে একদল সন্ত্রাসী মোহাম্মদপুর ঢাকা উদ্যানসংলগ্ন তুরাগ নদের ওপারে একটি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ৬ কর্মীকে গুলি করে এবং আরও ১৪ জনকে কুপিয়ে জখম করে। এ সময় সন্ত্রাসীরা জুয়েল নামের একজনকে হত্যা করে লাশ তুরাগে ফেলে দেয়। ওই হত্যাকাণ্ডে হাবিবুরের নাম উঠে আসে।

পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, হাবিবুরের সব ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পুলিশ অবগত থাকলেও ক্ষমতাসীন দলের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকায় তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ ছিল অসহায়।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার মো. আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এই বিভাগে নতুন এসেছেন। হাবিবুরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে পুলিশের একটি তদন্ত দল অনুসন্ধান করছে। তাঁর বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ দিলে তা মামলা হিসেবে গ্রহণ করা হবে।