বিচারে আগ্রহ নেই বাড়ছে 'বন্দুকযুদ্ধ'

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

গত বছর থেকে জোরেসোরে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু করে সরকার। এই অভিযানের মধ্যে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতের সংখ্যা উদ্বেগজনক। তবে মামলার বিচার নিষ্পত্তিতে সরকারের কোনো আগ্রহ নেই বললেই চলে। গত বছরের ১৪ নভেম্বর মাদক নিয়ন্ত্রণে নতুন আইনের অনুমোদন দেন রাষ্ট্রপতি। এই আইন অনুযায়ী মাদক অপরাধগুলোর বিচার হওয়ার কথা ছিল পৃথক ট্রাইব্যুনালে। তবে আইন হওয়ার ১১ মাসেও ট্রাইব্যুনাল হয়নি। ফলে গত ১১ মাসে এই আইনে হওয়া ৮০ হাজারের বেশি মামলার বিচার আটকে রয়েছে।

১১ মাস পর সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, মাদকদ্রব্য অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল করা হবে না। প্রচলিত আদালতেই যেন মাদক আইনে বিচার করা যায়, সে জন্য আইনটিরই সংশোধন করা হবে। এক বছর না যেতেই এখন আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

নতুন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৪৪ ধারায় বলা হয়েছে, মাদকদ্রব্য অপরাধ দমনে সরকার প্রয়োজনীয়সংখ্যক ‘মাদকদ্রব্য অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল’ স্থাপন করতে পারবে। অতিরিক্ত জেলা জজ পদমর্যাদার কর্মকর্তারা ট্রাইব্যুনালের বিচারক হবেন। ট্রাইব্যুনাল স্থাপিত না হওয়া পর্যন্ত সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে সংশ্লিষ্ট জেলার যেকোনো অতিরিক্ত জেলা জজ বা দায়রা জজকে তাঁর নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব দিতে পারবে।

প্রথম আলোর হিসাব অনুযায়ী, গত বছর শুরু হওয়া মাদকবিরোধী অভিযানের ৪৯৭ দিনে বন্দুকযুদ্ধে ৪৫৬ জন সন্দেহভাজন মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। আইন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে বিচারাধীন মোট ১১ লাখ ৭১ হাজার মামলার মধ্যে ৩ লাখ ১২ হাজারই মাদক অপরাধের মামলা, যা মোট মামলার প্রায় ২৭ শতাংশ। অন্যদিকে গত ১১ মাসে নতুন মাদক আইনে মামলার সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দুজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, দেশে একক অপরাধ হিসেবে মাদক মামলা হয় সবচেয়ে বেশি। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ছাড়া এই বিপুল মামলা কোনোভাবেই দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভব নয়। এক থেকে দেড় যুগ ধরে এমন মামলা ঝুলে থাকার নজিরও রয়েছে। পরে সাক্ষীর অভাবে আসামিরা খালাস পেয়ে যান।

>

৪৯৭ দিনে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ৪৫৬ জন সন্দেহভাজন মাদক ব্যবসায়ী নিহত
বিচারাধীন ১১ লাখ ৭১ হাজার মামলার মধ্যে ৩ লাখ ১২ হাজারই মাদক অপরাধের মামলা

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জামালউদ্দিন প্রথম আলোকে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা অনেক দিন ধরেই ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে বলছি। এখন শুনছি আইন সংশোধন করা হবে। সবকিছুই নির্ভর করছে আইন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের ওপর।’

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো বলছে, আইন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের (ভেটিংয়ের) পরই এই আইনটি চূড়ান্ত করা হয়েছিল। অথচ এখন আইন মন্ত্রণালয় ট্রাইব্যুনালও গঠন করছে না, আবার আইন অনুযায়ী অন্য বিচারকদেরও মামলা বিচারের দায়িত্ব দিচ্ছে না।

আইন মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব বলেন, এই আইনে নির্বাহী হাকিমদের মাদক মামলার বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। মাদক মামলা বিচারের জন্য পৃথক ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হলে এ আইনের প্রায়োগিক জটিলতা সৃষ্টি হবে।

কেন আইন মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করতে পারেনি, সে বিষয়ে কোনো যুক্তি না দিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চিন্তা করছি আইনের এ ধারাটি সংশোধন করে পুরোনো ধাঁচেই বিচার করবার। এ বিষয়ে আমরা একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি। আশা করি, এ সপ্তাহেই আমরা আইনটি সংশোধনের জন্য পাঠাব।’

আইন মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো বলছে, এ আইনটি সংশোধন করে আইনের যেখানেই ‘ট্রাইব্যুনাল’ রয়েছে সেখানেই তার জায়গায় ‘আদালত’ শব্দটি বসানো হবে। প্রতিটি আদালতে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ বা সমপর্যায়ের বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের মধ্যে বিচারক নিযুক্ত হবেন।

গত মার্চে আইন মন্ত্রণালয় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিবকে পাঠানো এক চিঠিতে আইনটি সংশোধন করে ট্রাইব্যুনালের জায়গায় দ্রুত বিচার আদালত গঠনের কথা বলা হয়। এরপর গত এপ্রিলে এ আইন সংশোধন নিয়ে এক বৈঠকে দীর্ঘ আলোচনার পরও মন্ত্রিপরিষদ, জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা দ্রুত ট্রাইব্যুনাল গঠনের পক্ষে মত দিয়েছিলেন।

মাদক নিয়ন্ত্রণে সরকারের জিরো টলারেন্সের ঘোষণা শুধুই ঘোষণা কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে বিলম্ব কেন হলো বোঝা যাচ্ছে না। তবে এটা পরিষ্কার, এই উদাসীনতার ফলে আসামিরা বিচারের আওতায় আসছে না। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, মাদক মামলার দ্রুত বিচার করতে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা উচিত। এভাবে ৮০ হাজার মামলা ফেলে রাখা ঠিক হয়নি। আবার এক বছর পর এসে বলছে, আইন সংশোধন করা হবে। এর ফলে দীর্ঘসূত্রতা আরও বাড়ল। দেখা যাবে, বিচার যখন শুরু হবে, তখন সাক্ষী পাওয়া যাবে না।’