বাঁকখালী নদীতে 'স্বর্গের' জাহাজ

কক্সবাজারে রামুর বাঁকখালী নদীতে জাহাজ ভাসানো উৎসব। আজ বিকেলে তোলা। ছবি: আবদুল কুদ্দুস
কক্সবাজারে রামুর বাঁকখালী নদীতে জাহাজ ভাসানো উৎসব। আজ বিকেলে তোলা। ছবি: আবদুল কুদ্দুস

বাঁশ, বেত ও রঙিন কাগজ দিয়ে তৈরি ‘স্বর্গের জাহাজ’। বাঁকখালী নদীতে ভাসানো হলো সেই জাহাজ। একে একে নয়টি। এ সময় বেজে উঠল বাদ্যযন্ত্র। নাচগানে মেতে উঠলেন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের তরুণ-তরুণীরা।

কক্সবাজারের রামু উপজেলার বাঁকখালী নদীতে আজ সোমবার ২০০ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী এই উৎসবে যোগ দেয় অন্তত ১০ হাজার মানুষ। উপজেলার হাইটুপি, দ্বীপ শ্রীকুল, হাজারীকুল, রাখাইনপাড়া, দক্ষিণ শ্রীকুল, পূর্ব রাজারকুল জাদিপাড়া, মেরংলোয়াসহ অন্তত ২৪টি গ্রামের মানুষ যোগ দেয় এই জাহাজ ভাসানোর উৎসবে।

পাঁচ-ছয়টি নৌকাকে একসঙ্গে বেঁধে তার ওপর বসানো হয় জাহাজ। জাহাজে বাঁধা মাইকে বাজে বুদ্ধকীর্তন। এর সুরে ভাসতে ভাসতে জাহাজগুলো ছুটছিল নদীর এদিক–সেদিক।

উৎসব সম্পর্কে রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের সহকারী পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, প্রায় ২০০ বছর আগে মিয়ানমারের মুরহনঘা এলাকায় একটি নদীতে সংঘরাজ ম্রাজংব্রান প্রথম জাহাজ ভাসানো উৎসবের আয়োজন করেন। সেখান থেকে বাংলাদেশের রামুতে এই উৎসব প্রচলন হয়। রামু ছাড়া দেশের কোথাও জাহাজ ভাসানো উৎসব হয় না।

বৌদ্ধ ভিক্ষুরা জানান, আড়াই হাজার বছর আগে বৈশালী রাজ্যে অনাবৃষ্টি, খরা ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এর প্রভাবে মানুষ ও জীবজন্তু মারা যাচ্ছিল। তখন গৌতম বুদ্ধ বৈশালী রাজার আমন্ত্রণে শিষ্যদের নিয়ে ওই রাজ্যে যান। তিনি ‘রত্নসূত্র’ পাঠ করে খারাপ দেবতার প্রভাব থেকে বৈশালীকে রক্ষা করেন। ফিরতি পথে সর্পদেবতারা ৫০০টি নৌকায় শিষ্যসহ বুদ্ধকে নদী পার করে দেন। সেই দিনকে স্মরণ করতেই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ জাহাজ ভাসানো উৎসব পালন করে আসছে। প্রতিবছর তিন মাস ভিক্ষুদের বর্ষাব্রত পালন শেষে প্রবারণা পূর্ণিমার পরের দিন জাহাজ ভাসানো উৎসবের আয়োজন করা হয়।

উৎসবের কিছুদিন আগে থেকে ঢোল, মন্দিরা, বাঁশিসহ নানা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে বৌদ্ধকীর্তন গেয়ে গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে টাকা সংগ্রহ করে শিশু কিশোর ও যুবকেরা। সেই টাকায় তৈরি হয় ময়ূর, কবুতর, হাঁসসহ বিভিন্ন প্রতিকৃতির একাধিক স্বর্গের জাহাজ।

আজকের উৎসব উপলক্ষে বাঁকখালী নদীর ফকিরাবাজার অংশে বালুচরে আয়োজিত হয় আলোচনা সভা। এতে সভাপতিত্ব করেন প্রবারণা ও জাহাজ ভাসানো উৎসব উদ্‌যাপন পরিষদ আহ্বায়ক জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।

জাহাজ ভাসানো উৎসবে আনন্দে মেনে ওঠে হাজারো মানুষ। ছবি: আবদুল কুদ্দুস
জাহাজ ভাসানো উৎসবে আনন্দে মেনে ওঠে হাজারো মানুষ। ছবি: আবদুল কুদ্দুস

সন্ধ্যায় প্রয়াত বৌদ্ধধর্মীয় গুরু ও রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের অধ্যক্ষ পণ্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথেরর স্মৃতির প্রতি পুণ্যদান করতে আকাশে ফানুস ওড়ানো হয় এবং এক হাজার মঙ্গলপ্রদীপ নদীতে ভাসানো হয়।

আজকের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন কক্সবাজার-৩ আসনের সাংসদ সাইমুম সরওয়ার কমল। বিশেষ অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন, পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন, এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী মুন্নী সাহা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রণয় চাকমা, বৌদ্ধধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ভাইস চেয়ারম্যান সুপ্ত ভূষণ বড়ুয়া, কক্সবাজার জেলা পূজা উদ্‌যাপন পরিষদ সাধারণ সম্পাদক বাবুল শর্মা প্রমুখ।

সাংসদ সাইমুম সরওয়ার কমল বলেন, ২০১২ সালে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনার পর রামুতে সম্প্রীতি ফিরে এসেছে। আজকের সম্প্রীতির জাহাজ ভাসানোর এ অনুষ্ঠান তার প্রমাণ।

পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন বলেন, রামুর বৌদ্ধপল্লিতে দ্বিতীয়বার হামলার সাহস কারও নেই। জাহাজ ভাসানো উৎসবে বিপুল বৌদ্ধ, হিন্দু, মুসলিম এবং দেশি-বিদেশি পর্যটকের উপস্থিতি প্রমাণ করে, রামু এখন শান্তি ও সম্প্রীতির শহর।

জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘উৎসবে না এলে বুঝতে পারতাম না এ উৎসব কতটা বৈচিত্র্যপূর্ণ।’