দেশের কাতানে বিশ্বমানের টাই

বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় বো–টাই বা নেকটাই আমাদের এখানে ‘ফুল টাই’ হিসেবে পরিচিত। পুরুষের গলায় ফুলের মতোই শোভা পায় এই টাই। আমাদের দেশে এই টাইয়ের ব্যবহার তেমন একটা দেখা যায় না। তবে এখন বাংলাদেশে তৈরি বিশেষ ধরনের ফুল টাইয়ের প্রশংসা করছে বিশ্ববাসী। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী কাতান কাপড় দিয়ে তৈরি হচ্ছে এই টাই। এই অভিনব উদ্যোগের পেছনে আছে ‘টাইগারবো’ এবং এর প্রতিষ্ঠাতা ওয়াহিদ হোসেন।

গতকাল সোমবার ঢাকার মিরপুরে এই তরুণ উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা হলো। ওয়াহিদ জানান, টাইগারবোর শুরুটা ২০১৫ সালের দিকে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বিলাসবহুল বো–টাইয়ের বাজারের প্রায় ২ দশমিক ৫ শতাংশ একাই দখল করে নিয়েছে তাঁর টাইগারবো। কাতানের টাই মুগ্ধ করছে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাবাসীদের। গত বছর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠান কিনেছে ৩২০টি কাতানের বো–টাই।

টাইগারবোর তৈরি বিশ্বমানের টাই। মিরপুর, ঢাকা, ১৫ অক্টোবর। ছবি: আবদুস সালাম
টাইগারবোর তৈরি বিশ্বমানের টাই। মিরপুর, ঢাকা, ১৫ অক্টোবর। ছবি: আবদুস সালাম

ওয়াহিদের জন্ম ১৯৯১ সালে, ঢাকার মিরপুরে। মিরপুর বাঙলা হাইস্কুল থেকে ব্যবসায় শিক্ষায় এসএসসি পাস করেন। একই বিষয়ে কলেজের পাঠ শেষ করেন সেন্ট যোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। তারপর মার্কেটিংয়ে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ শেষ করে ফেলোশিপ নিয়ে পড়তে যান যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াটসন ইউনিভার্সিটিতে। এখানে পড়ার সময়েই একই সঙ্গে টেকসই ব্যবসা, নারীর সামাজিক উন্নয়ন এবং সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে—এমন উদ্যোগ নেওয়ার কথা তাঁর মাথায় আসে। ওয়াটসন ইউনিভার্সিটিতে তাঁর পড়াশোনার বিষয় ছিল ‘সোশ্যাল ইনোভেশন অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ’।

টাইগারবোর প্রতিষ্ঠাতা ওয়াহিদ হোসেন। মিরপুর, ঢাকা, ১৫ অক্টোবর। ছবি: আবদুস সালাম
টাইগারবোর প্রতিষ্ঠাতা ওয়াহিদ হোসেন। মিরপুর, ঢাকা, ১৫ অক্টোবর। ছবি: আবদুস সালাম

ওয়াহিদ বললেন, ‘আমি এমন এক সামাজিক ব্যবসা করতে চেয়েছি, যার মাধ্যমে আমার দেশের নারীদের ক্ষমতায়ন হবে।’ তিনি আরও বললেন, ‘বাংলাদেশ থেকে প্রথম শুরু হবে—এমন কোনো পণ্যের আইডিয়া খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সবই অন্যান্য দেশে হয়ে গেছে। তখন দেশের কাতান দিয়ে বিশ্বমানের টাই তৈরির কথা মাথায় আসে।’

শুরুতে বাংলাদেশের কেউ ওয়াহিদকে উৎসাহিত বা অনুপ্রাণিত করেনি। সবাই বলেছে, কাতান শাড়িই এখন কেউ পরে না, টাই করার প্রশ্নই আসে না। তারপরও ওয়াহিদ কাতান দিয়ে পাঁচটি টাই তৈরি করে হাজির হন ওয়াটসন সামিটে। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অতিথিরা বাংলাদেশের চোখজুড়ানো কাপড়ে তৈরি টাইগুলো পছন্দ করল। সব কটি টাই বিক্রি হয়ে যায়। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাননি ওয়াহিদ।

কাতানের ফুল টাই তৈরিতে ব্যস্ত সালমা আক্তার। মিরপুর, ঢাকা, ১৫ অক্টোবর। ছবি: আবদুস সালাম
কাতানের ফুল টাই তৈরিতে ব্যস্ত সালমা আক্তার। মিরপুর, ঢাকা, ১৫ অক্টোবর। ছবি: আবদুস সালাম

তিনজন নারী কর্মী নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল টাইগারবো, এখন কাজ করছেন ১৩ জন নারী। টাইগারবোর কর্মীরা ঘণ্টায় ৬ ডলার আয় করে থাকেন। টাইগারবোর পুরোনো কর্মী সালমা আক্তার। তাঁর সঙ্গেও কথা হলো। সালমা বললেন, ‘আগে আমি টুকটাক সেলাইয়ের কাজ করতাম। ওয়াহিদের সঙ্গে কাজ করার পর থেকে বেশ ভালো আছি, আয়ও ভালো।’ সালমা এখন শুধু কাতন দিয়ে টাই-ই তৈরি করেন না, টাই তৈরির প্রশিক্ষণও দেন।

ওয়াহিদের সামাজিক ব্যবসার এই উদ্যোগ তুলেছে আলোড়ন। ওয়াহিদ তাঁর এই ভাবনা নিয়ে কলোরাডো ইউনিভার্সিটির ‘টেডএক্স টক’-এ কথা বলেছেন। কলোরাডো মেসা ইউনিভার্সিটি এবং হার্ভার্ড ক্লাব নিউইয়র্কের নিয়ন্ত্রণে নিজের উদ্যোগ নিয়ে আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। ওয়াহিদ জানান, সম্প্রতি কলোরাডো ইউনিভার্সিটি তাঁর উদ্ভাবনী চিন্তাকে তাদের এমবিএ কোর্সে অন্তর্ভুক্ত করেছে। নিউইয়র্কের ‘দ্য রেজুলেশন প্রজেক্ট’সহ বেশ কিছু মার্কিন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করছে বাংলাদেশের টাইগারবো।

ওয়াহিদ আরও কিছু নতুন পণ্য তৈরির কথা ভাবছেন বলে জানালেন। ইতিমধ্যে কিছু গয়না তৈরির কাজে হাত দিয়েছেন।