জাহাজভাঙা কারখানায় বন্ধ হচ্ছে না দুর্ঘটনা

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের জাহাজভাঙা কারখানাগুলোতে মালিকপক্ষ ও শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়লেও দুর্ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না। গত ১৫ দিন পাঁচটি দুর্ঘটনায় পাঁচ শ্রমিক মারা গেছেন। আহত হয়েছেন আরও দুজন। সর্বশেষ গত সোমবার দুপুরে শীতলপুর সাগরিকা শিপইয়ার্ড লিমিটেড নামের একটি জাহাজভাঙা কারখানায় ট্রাক থেকে গ্যাস সিলিন্ডার নামাতে গিয়ে অপু চাকমা ও তপন চাকমা নামের দুই শ্রমিক আহত হন। 

এসব দুর্ঘটনার কারণে গতকাল পর্যন্ত জিরি সুবেদার এবং ওডব্লিউডব্লিউ নামের দুটি জাহাজভাঙা কারখানা সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার।

জাহাজভাঙা কারখানা নিয়ে কাজ করা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, কারখানাগুলোতে দুর্ঘটনা রোধে আগের তুলনায় বেশি প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। সচেতন করা হচ্ছে মালিকপক্ষের লোকজনকে। তবু দুর্ঘটনা থামছেই না। প্রতিটি দুর্ঘটনায় সীতাকুণ্ড থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়। থানায় দায়ের করা মামলায় তদন্ত শেষে প্রায় সব মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়।

তবে দুর্ঘটনার কারণে কারখানার মালিকেরাও উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশ শিপব্রেকার্স ও রিসাইক্লিং অ্যাসোসিয়েশন (বিএসবিআরএ) বলেছে, কিছু কিছু মালিকের উদাসীনতার কারণে দুর্ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না। তাদের চিহ্নিত করে সতর্ক করা হয়েছে।

>গত ১৫ দিনে ৫ শ্রমিকের মৃত্যু।
এ বছরে মারা গেছেন ২১ জন।
দুটি কারখানা বন্ধ ঘোষণা।

কয়েকটি দুর্ঘটনা

পুলিশ সূত্র জানায়, গত ২৬ সেপ্টেম্বর ছোট কুমিরা সাগরপারে মাদারস্টিল নামের একটি জাহাজভাঙা কারখানায় জোয়ারের পানিতে ডুবে মো. স্বপন নামে এক শ্রমিক মারা যান। তিনি স্ক্র্যাপ জাহাজ থেকে গ্যাসের বোতল আনা–নেওয়ার কাজ করতেন। 

এ ঘটনার দুদিন পর ২৯ সেপ্টেম্বর সোনাইছড়ি ইউনিয়নের সাইনবোর্ড এলাকায় যমুনা শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে স্ক্র্যাপ জাহাজ থেকে পড়ে আবু বক্কর নামের এক শ্রমিক মারা যান।

৭ অক্টোবর ভাটিয়ারী ইউনিয়নের কদমরসুল সাগরপারে এইচএম শিপব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রিজ নামের জাহাজভাঙা কারখানায় রবিউল ইসলাম নামের এক শ্রমিক নিহত হন।

১২ অক্টোবর কুমিরা ফেরিঘাট এলাকায় ওডব্লিউডব্লিউ নামের একটি জাহাজভাঙা কারখানায় গ্যাসের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সাইফুল ইসলাম (২২) ও মোহাম্মদ মাসুদ (২০) নামের দুই শ্রমিকের মৃত্যু হয়। গতকাল কারখানাটি সাময়িক বন্ধ করে দেয় শিল্প মন্ত্রণালয়।

ইপসা যা বলছে

জাহাজভাঙা কারখানা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) ইপসার তথ্যমতে, চলতি বছরের শুরু থেকে গতকাল পর্যন্ত বিভিন্ন জাহাজভাঙা কারখানায় ২১ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন আরও ৩৭ জন। সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ১৭।

প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী শাহীন প্রথম আলোকে বলেন, কিছু কিছু মালিক এখন আগের তুলনায় অনেক সচেতন। তাঁরা নিজেদের শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে নামান। তাই তাঁদের কারখানায় দুর্ঘটনা কম। এটি একটি ইতিবাচক দিক। আর কিছু মালিক আছেন, যাঁরা শ্রমিকদের মানুষও মনে করেন না। তাঁরা কোনোমতে কাজে লাগিয়ে টাকা আয় করতে চান। এ ধরনের মালিকদের কারখানায় শ্রমিকেরা মারা যাচ্ছেন।

মোহাম্মদ আলী শাহীন বলেন, কিছু এনজিও জাহাজভাঙা শ্রমিকদের নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ দিতে চাইলেও কিছু মালিকপক্ষ তাদের সহযোগিতা করেন না। হয়তো মালিকদের ধারণা হতে পারে, শ্রমিকদের এনজিওগুলো নেতিবাচক ধারণা দেবে। এনজিওগুলো জাহাজভাঙা কারখানা বন্ধ চায় না। বরং কারখানার দুর্ঘটনা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে চায়।

‘কেন জানি দুর্ঘটনা থামছেই না’

কলকারখানা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পরিদর্শক পলাশ কুমার দাশ প্রথম আলোকে বলেন, কারখানা মালিকপক্ষ ও শ্রমিকেরা আগের থেকে অনেক সচেতন। তবু কেন জানি দুর্ঘটনা থামছেই না। প্রতিটি দুর্ঘটনায় তাঁরা কারখানা কর্তৃপক্ষকে নোটিশ দেন। নোটিশের জবাব যথাযথ না পেলে শ্রম আদালতে মামলা করেন। তবে এখন পর্যন্ত শ্রম আদালতে কতটি মামলা দায়ের করেছেন, তা তিনি তাৎক্ষণিক জানাতে পারেননি।

জানতে চাইলে বিএসবিআরএর সভাপতি মো. আবু তাহের প্রথম আলোকে বলেন, কিছু কারখানার মালিক রয়েছেন, যাঁরা দক্ষ সেফটি অফিসার (নিরাপত্তা কর্মকর্তা) নিয়োগ দেন না। তাঁদের চিহ্নিত করা হয়েছে। দুদিন আগে মালিকদের একটি সভায় শ্রমিকদের নিরাপত্তা বিষয়ে চিহ্নিত কিছু মালিককে সতর্ক করা হয়েছে।

শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে আবু তাহের বলেন, জাহাজভাঙা কারখানায় যে শ্রমিকেরা কাজ করেন, তাঁদের বেশির ভাগ দেশের উত্তরাঞ্চলের। ধান কাটা শুরু হলে তাঁরা চলে যান। স্থায়ীভাবে শ্রমিকেরা না থাকায় প্রশিক্ষণে কিছুটা অসুবিধাও হয়। প্রশিক্ষণবিহীন শ্রমিকের সংখ্যা খুবই কম বলে তিনি জানান।

সীতাকুণ্ড থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শামীম শেখ প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ঘটনার পর নিহত ব্যক্তির পরিবার কিংবা পুলিশের পক্ষ থেকে একটি অপমৃত্যুর মামলা দেওয়া হয়। মামলায় দুর্ঘটনায় মালিকপক্ষের অবহেলা ছিল কি না খতিয়ে দেখা হয়। তবে দু-একটা ছাড়া প্রায় সব মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়।

এবার বন্ধ ওডব্লিউডব্লিউ

সীতাকুণ্ডে এবার ওডব্লিউডব্লিউ ট্রেডিং অ্যান্ড শিপব্রেকিং ইয়ার্ড-১ নামে জাহাজভাঙা কারখানাটিও সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। গতকাল এ–সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরে পাঠিয়েছে মন্ত্রণালয়। নির্দেশনা পাওয়ার পর গতকাল থেকেই জাহাজভাঙা কারখানাটি বন্ধ ঘোষণা করে উপজেলা প্রশাসন।

এর আগে গত ৩১ আগস্ট উপজেলার সোনাইছড়ি ইউনিয়নের ফুলতলায় জিরি সুবেদার নামের শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে দুই শ্রমিক নিহত এবং ১৩ শ্রমিক আহত হন। এরপর দিন গত ১ সেপ্টেম্বর কারখানাটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে কারখানাটি বন্ধ রয়েছে।

মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো নির্দেশনায় দেখা গেছে, ১০ অক্টোবর ওডব্লিউডব্লিউ ট্রেডিং অ্যান্ড শিপব্রেকিং ইয়ার্ড-১ কারখানাটি ভাঙার জন্য আনা এমবি সিরা নামের একটি জাহাজ উপকূলে ভেড়ায়। জাহাজ ভাঙার শর্ত অনুসারে প্রতিটি জাহাজ ভাঙার আগে বর্জ্যসংক্রান্ত কার্যক্রম সমাপ্ত, সেফটি এজেন্সি কর্তৃক জাহাজটি কাটার পরিকল্পনা ও অন্যান্য কাগজপত্রসহ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে হয়। কিন্তু ওই জাহাজভাঙা কারখানাটি কোনো আবেদন না করে বেআইনিভাবে জাহাজটি কাটা শুরু করে। ফলে গ্যাস বিষক্রিয়ায় দুই শ্রমিক নিহত এবং এক শ্রমিক আহত হন। জাহাজভাঙা নীতিমালা-১১ অনুসারে, কারখানাটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সৈয়দ মাহবুবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সীতাকুণ্ডে ১৯১টি জাহাজভাঙা কারখানা রয়েছে। তার মধ্যে ৯০টি কারখানার ইজারা নবায়ন আছে।