খাবার নষ্টের সংস্কৃতিতে উদ্বিগ্ন পৃথিবী

খাবার নষ্টের বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক আমেরিকান প্রচারণা। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
খাবার নষ্টের বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক আমেরিকান প্রচারণা। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

২০১৬ সালের জুলাই মাসে ইতালি খাবার নষ্ট রোধ করা বাঁচাতে আইন করেছে। বিক্রি না হওয়া খাবার এখন থেকে ব্যবসায়ীরা ফেলে না দিয়ে দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে দান করবে। হিসাব করে দেখা গেছে এই কাজ করলে তার পরিবেশ, অর্থনৈতিক আর নৈতিক লাভ অনেক বেশি। ফ্রান্স এ রকম আইন পাস করেছে ২০১৭ সালে। সেখানে খাবার নষ্ট করলে জরিমানার বিধান হয়েছে। ইতালি নিয়েছিল ভিন্ন পন্থা। যেসব প্রতিষ্ঠান খাবার নষ্ট না করে দান করবে, তাদের জন্য বিশেষ ছাড় দেওয়া হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে খাবার নষ্ট রোধ করার জন্য বিল আনার প্রস্তুতি চলছে।

সব উন্নত দেশগুলোতে অভাবকে নতুন করে দেখার এক প্রস্তুতি দেখা যাচ্ছে। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় খাদ্য আর ক্ষুধার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। খাদ্যের সঙ্গে সম্পর্ক মুনাফার। ফলে কে না খেল তার সঙ্গে উৎপাদনের সম্পর্ক নেই। একমাত্র দেখার ব্যাপার খাদ্য নিয়ে মুনাফা হচ্ছে কি না। ফলে একদিকে খাবার নষ্ট হচ্ছে, আরেক দিকে গরিব মানুষ না খেয়ে থাকছে। এর কারণ খাবারের অভাব নয়।

খাবার দুভাবে নষ্ট হয়। একদিকে খাবার উৎপাদন থেকে শুরু করে ক্রেতার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত প্রক্রিয়াতে খাদ্য নষ্ট হয় ব্যাপকভাবে। আরেকটি হচ্ছে খাবার প্রস্তুত করা বা তৈরি হওয়ার পর যে খাবার নষ্ট হয়। খাবারের ব্যবসা করা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রচুর খাবার নষ্ট হয়। তারা বিক্রি না হওয়া খাবার নষ্ট করে বা ফেলে দেয়। ফ্রান্সের ব্যাপারটা বিবেচনা করা যাক। ইদানীং সে দেশে বেকারত্ব আর গৃহহীন মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। অনেক পরিবার খাবারের সংকটে ভুগছে। মুদি দোকানগুলোর ফেলে দেওয়া খাবার নেওয়ার জন্য দরিদ্র মানুষেরা দোকানের জিনিসপত্র ফেলার জায়গায় ভিড় করছে। অনেক দোকানের ম্যানেজার ফেলে দেওয়া খাবারের ওপর ব্লিচিং পাউডার ঢেলে দিচ্ছে। কেউবা সেখানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছে, যাতে গরিব লোকেরা ফেলে দেওয়া ভালো খাবারগুলো নিতে না পারে। এসব সামলানোর জন্য ফরাসি সরকার আইন করল যাতে এই নিষ্ঠুর আচরণ প্রতিহত করা যায়। সুপার মার্কেটগুলো যদি এখন খাবার নষ্ট করে, বেঁচে যাওয়া খাবার গরিব মানুষকে দেওয়ার ব্যবস্থা না করে, তাহলে জরিমানা এমনকি জেল পর্যন্ত হতে পারে।

প্রতীকী ছবি। ছবি: সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। ছবি: সংগৃহীত

মাঠ থেকে আমাদের থালা পর্যন্ত পৌঁছানোর প্রতিটি স্তরেই খাদ্য নষ্ট হয়। মাঠে ফসল বোনা, তার পরিচর্যা, ফসল কাটা, প্রক্রিয়াজাত করা, দোকানে পৌঁছানো, ক্রেতা খরিদ করা—প্রতিটি স্তরেই একে নষ্ট হওয়া থেকে বাঁচানো এখন একটা বৈশ্বিক উদ্বেগের ব্যাপার হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘের পরিবেশসংক্রান্ত কার্যক্রম (UN Environment) একটা ভয়াবহ তথ্য জানাচ্ছে। তাদের মতে, প্রতিবছর পৃথিবীতে যে পরিমাণ ফল ও সবজি উৎপাদিত হয় তার অর্ধেক নষ্ট হয়।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ফাও) হিসাব করে দেখিয়েছে, বছরে পৃথিবীতে ১৪০ কোটি টন খাদ্য নষ্ট হয়। তা দিয়ে ২ কোটি মানুষকে খাওয়ানো যায়। নষ্ট হওয়া খাবার পুরো দুনিয়ার মোট খাদ্য জোগানের এক-তৃতীয়াংশ। যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৪ সালের হিসাব অনুযায়ী প্রতিবছর ১৩৩ বিলিয়ন পাউন্ড খাদ্য নষ্ট হয়। এই পরিমাণ সেই দেশের মোট খাদ্য সরবরাহের ৩১ শতাংশ। জনপ্রতি বছরে ৪২৯ পাউন্ড খাবার নষ্ট করা হয়। ২০১০ সালে মার্কিন দেশে মোট নষ্ট করা খাবারের দাম হলো প্রায় ১৬২ বিলিয়ন ডলার।

unenvironment.org এ কিছু উদ্বেগজনক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। শিল্পোন্নত দেশে বছরে খাদ্য নষ্ট হয় ৬৮০ বিলিয়ন ডলার আর উন্নয়নশীল দেশে ৩১০ বিলিয়ন ডলার। দুই রকম দেশেই মোটামুটি সমান পরিমাণ খাদ্য নষ্ট হয়, যথাক্রমে ৬৭০ এবং ৬৩০ মিলিয়ন টন। ধনী দেশগুলোতে বছরে ভোক্তারা ২২২ মিলিয়ন টন খাবার নষ্ট করে, যা সাব-সাহারা দেশগুলোর মোট খাদ্য উৎপাদনের সমান (২৩০ মিলিয়ন টন)। ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকায় বছরে মাথাপিছু নষ্ট করা খাবারের পরিমাণ প্রায় ১১৫ কেজি। সাব-সাহারা, দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় মাথাপিছু খাবার নষ্ট করা হয় বছরে ৬-১১ কেজি। যে পরিমাণ খাবার দুনিয়াজুড়ে বর্তমানে নষ্ট করা হয় তার এক-চতুর্থাংশও যদি বাঁচানো যায়, তাহলে তা দিয়ে ৮৭০ মিলিয়ন ক্ষুধার্ত মানুষকে খাওয়ানো যাবে। এই তথ্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।

এ বছরের ১৫ জুন গার্ডিয়ান পত্রিকা জাতিসংঘের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে জানাচ্ছে যে বিশ্বজুড়ে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৮২০ মিলিয়ন। দ্য ল্যানসেট নামে একটি জার্নালের এ বছরের ৩ এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, যথেষ্ট পুষ্টিকর খাবার না খাওয়ার ফলে ২০১৭ সালে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এই সংখ্যা ওই বছরের মোট বয়স্ক লোকের মৃত্যুর ২২ শতাংশ। ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধামুক্ত পৃথিবীর যে স্বপ্ন দেখা হচ্ছে, তা আসলেও খুব বাস্তব বলে মনে হচ্ছে না।

এই সব তথ্য এখন আর শুধু পরিসংখ্যান পর্যায়ে থেমে নেই। বিশ্বনেতারা বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন। গত ১২ জুন পূর্ব ইউরোপের দেশ মলদোভাতে বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ইউরোপ আর মধ্য এশিয়ার আঞ্চলিক দপ্তর বিশেষ আলোচনার আয়োজন করেছে। এই দেশগুলো খাদ্য নষ্ট করা রোধ করতে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে সম্মত হয়েছে। এর আগে এ বছরের ১৭ মে ইউরোপীয় ফুড ব্যাংক ফেডারেশন খাদ্য নষ্ট রোধে যথাযথ কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে আন্তর্জাতিক সভার আয়োজন করেছে।

বেশি উৎপাদন দিয়ে মানুষকে সুখী করার ধারণা এখন দুনিয়াজোড়া প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে, যা উৎপাদন হচ্ছে তার যথাযথ ব্যবহার করার দিকটি অবহেলা করলে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ আমাদের পৃথিবী একটাই। তার সামর্থ্যের সীমা আছে। আর খাদ্য যে প্রথমত ক্ষুধার্তের জন্য, এই সত্যখানি এখন দুনিয়াজোড়া সামনে উঠে আসছে। একে আর এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।