হাতপাখায় ঘোরে সংসার

কেউ কাটছেন বাঁশ। কেউ বাঁশ দিয়ে বানাচ্ছেন চাক। সুতা গোছাচ্ছেন কেউ। আর কেউ করছেন সেলাই। এভাবে তৈরি হচ্ছে হাতপাখা। এই পাখা বিক্রির আয়ে ঘুরছে দুটি গ্রামের প্রায় এক শ পরিবারের সংসারের চাকা। অভাব আর চোখ রাঙাতে পারছে না তাদের।

গ্রাম দুটি গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলায় অবস্থিত। একটি রসুলপুর ইউনিয়নের আরাজি ছান্দিয়াপুর, আরেকটি পাশের জামালপুর ইউনিয়নের বুজরুক রসুলপুর। জেলা শহর থেকে প্রায় ২৭ কিলোমিটার দূরে গ্রাম দুটির অবস্থান।

আরাজি ছান্দিয়াপুর গ্রামের মরিয়ম বেগম বললেন, ‘আগে অন্যের জমি আদি (বর্গাচাষ) করচি, আর মানসের বাড়িত ঝিয়ের কাম করচি। যা কামাই করচি, তাক পেটে-ভাতে সই হচে। ঈদোত ছোলপোলোক নয়া কাপড়া দিব্যার পাই নাই। একন হামরা ভালো আচি।’

স্থানীয় বাসিন্দা এবং ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশনের (বিসিক) গাইবান্ধা কার্যালয় সূত্র জানায়, ওই দুই গ্রামে প্রায় ছয় হাজার মানুষের বাস। গ্রাম দুটির বেশির ভাগ মানুষ দরিদ্র ছিল। দিনমজুরের কাজ করে অনাহার-অর্ধাহারে সংসার চলত। নুন আনতে পান্তা ফোরায় অবস্থা। এখন সুতার পাখা তৈরি করে ১০০টি পরিবার জীবিকা নির্বাহ করছে।

জানতে চাইলে জামালপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান মণ্ডল বলেন, ওই দুই গ্রামের মানুষ পাখা তৈরি করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। অন্যদের জন্যও তাঁরা দৃষ্টান্ত হতে পারেন।

সম্প্রতি গ্রাম দুটি ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় পাখা তৈরি করা হচ্ছে। শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক নারী-পুরুষ পাখা তৈরিতে ব্যস্ত। কেউ সুতা গোছানো, কেউ বাঁশ কাটা, কেউ বাঁশের চাক তৈরি, কেউ সুই দিয়ে সেলাই করছেন।

সুতা দিয়ে পাখা তৈরি করছেন নারী-পুরুষেরা। সম্প্রতি গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার বুজরুক রসুলপুর গ্রামে।  ছবি: প্রথম আলো
সুতা দিয়ে পাখা তৈরি করছেন নারী-পুরুষেরা। সম্প্রতি গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার বুজরুক রসুলপুর গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

গ্রাম দুটির কয়েকজন জানান, সুতার পাখা তৈরি করে এ দুটি গ্রামের প্রায় ১০০টি পরিবার অভাব ঘুচিয়েছে। এখন প্রতিটি পরিবার মাসিক আয় আট-দশ হাজার টাকা। প্রায় আট বছর ধরে তারা সুতা ও বাঁশের চাক দিয়ে পাখা তৈরি করছে। নানা রং ও ডিজাইনের হাতপাখা তৈরি করে তারা। প্রতিটি পাখা তৈরি করতে ১২ টাকার সুতা, দুই টাকার বাঁশের হাতল, দুই টাকার সুতা মোড়ানোর কাপড়, পারিশ্রমিকসহ প্রায় ২০ টাকা ব্যয় হয়। প্রতিটি পাখা ২৫ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এসব পাখা আশপাশের চাহিদা মেটানোর পর ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, রংপুরসহ বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হচ্ছে।

আরাজি ছান্দিয়াপুর গ্রামের জলিল মিয়া বলেন, ‘আগে কমলা দিয়া সোংসার চালাচি। ঠিকমতন খাবার পাই নাই। একন পাকা (পাখা) বেচি পোত্তেক মাসে আট হাজার ট্যাকা কামাই করি। হামারঘরে আর অবাব নাই।’

বুজরুক রসুলপুর গ্রামের আবুল কাশেম বলেন, ‘হামারঘরে সোংসারের সগলে পাকা বানানোর কাম করে। কাউও বসি থাকে না। পাইকাররা হামারঘরে বাড়িত থাকি পাকা নিয়া যায়। পাইকার না আলে হামরাই পাকা হাটোত নিয়া যাই। পাকা বেচি পোত্তেক মাসে দশ হাজার ট্যাকা আয় করব্যার নাগচি।’

একই গ্রামের সেকেন্দার আলী বলেন, ‘গরমের দিনে পাকার চাইদা বেশি। একজনে পোত্তেক দিন চার থেকে পাঁচটি পাকা বানব্যার পারে।
কিনতো হামারঘরে ট্যাকা (মূলধন) কম। বেশি করি বানব্যার পাইনে। সোরকাল হামারঘরোক লোন (ঋণ) দ্যায় না। দিলে আরও আয়-উননোতি করব্যার
পানো হয়।’

জানতে চাইলে বিসিকের গাইবান্ধা কার্যালয়ের সহকারী মহাব্যবস্থাপক শাহ মো. জোনায়েদ মুঠোফোনে বলেন, দুই গ্রামের উৎপাদিত পাখা বাজারজাতকরণে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়ার জন্য তালিকা তৈরির কাজ চলছে।