মুসা বিন শমসেরের বিরুদ্ধে মামলা

মুসা বিন শমসের। ফাইল ছবি
মুসা বিন শমসের। ফাইল ছবি

বিতর্কিত ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসেরসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ক্ষমতার অপব্যবহার ও জালিয়াতির মাধ্যমে কার্নেট ডি প্যাসেজ সুবিধায় আনা বিক্রয়নিষিদ্ধ গাড়ি নিবন্ধন করে ব্যবহারের অভিযোগে এ মামলা হয়। দুদকের পরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলী আজ বৃহস্পতিবার সংস্থার বরিশাল সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলাটি করেন।

সংস্থাটির মুখপাত্র প্রণব কুমার ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

মামলায় আরও আসামি করা হয়েছে ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী ফরিদ নাবির, বিআরটিএ ভোলা জেলা সার্কেলের সহকারী পরিচালক মো. আইয়ুব আনছারী (বর্তমানে ঝালকাঠিতে কর্মরত), গাড়ি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান অটো ডিফাইন ও ফিয়াজ এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. ওয়াহিদুর রহমান এবং মুসা বিন শমসেরের শ্যালক মো. ফারুকুজ্জামানকে।

সূত্র জানিয়েছে, ২০১০ সালের ১২ মার্চ বিলাসবহুল রেঞ্জ রোভার মডেলের গাড়িটি কার্নেট ডি প্যাসেজ সুবিধায় বাংলাদেশে আনেন ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী ফরিদ নাবির।

কারনেট ডি প্যাসেজ এমন একটি ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে একজন পর্যটক বা ভ্রমণকারী নিজ গাড়ি চালিয়ে বিভিন্ন দেশের মধ্যে যাতায়াত করতে পারেন। সাময়িক আমদানিসুবিধার আওতায় গাড়িটি কোনো ধরনের শুল্ক-কর পরিশোধ ছাড়াই চলাচল করতে পারে। কিন্তু এই সুবিধায় আনা গাড়ি বিক্রি করা যায় না। এটি ব্যবহার শেষে ফেরত নিয়ে যেতে হয়।

রেঞ্জ রোভার গাড়িটি আলোচনায় আসে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের একটি অভিযানের পর। ২০১৭ সালের ২১ মার্চ এক অভিযানে গাড়িটি জব্দ করে শুল্ক গোয়েন্দারা। গাড়ি জব্দ নিয়েও হয় দিনভর নাটক। শুল্ক গোয়েন্দার তৎকালীন মহাপরিচালক মইনুল খান ওই দিন জানিয়েছিলেন, মুসা বিন শমসেরকে গাড়ি হস্তান্তর করার জন্য নোটিশ দেওয়া হয় সেদিন সকাল আটটায়। তাঁর গুলশান ২ নম্বরের ১০৪ নম্বর সড়কের ৫এ/বি নম্বর বাড়িতে রাখা ছিল। কিন্তু শুল্ক গোয়েন্দাদের উপস্থিতি টের পেয়ে সকালে গাড়িটি অন্য জায়গায় সরিয়ে ফেলেন তিনি। এটি ওই বাড়ির সিসিটিভি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজে পাওয়া যায়। গাড়িটি প্রথমে পাঠানো হয় ধানমন্ডিতে বসবাসকারী মুসার এক আত্মীয়ের বাসায়। এর আগে ওই গাড়িতে করে সকাল সাড়ে ছয়টায় মুসার নাতিকে ধানমন্ডির সানবিম স্কুলে পাঠানো হয়। তবে স্কুল ছুটির সময় বেলা দুইটার দিকে আরেকটি গাড়িতে করে ওই নাতিকে গুলশানের বাড়িতে আনা হয়। রেঞ্জ রোভার গাড়িটি থাকে ধানমন্ডির বাড়িতে। প্রায় সাত ঘণ্টা পর ধানমন্ডির বাড়ি থেকে বেলা সাড়ে তিনটার দিকে শুল্ক গোয়েন্দারা গাড়িটি উদ্ধার করেন।

গাড়িটি উদ্ধারের পর অনুসন্ধানে নামে শুল্ক গোয়েন্দা। অনুসন্ধানে দেখা যায়, গাড়িটি (ভোলা ঘ১১-০০-৩৫ হিসেবে) ভুয়া আমদানি দলিলাদি দিয়ে রেজিস্ট্রেশন নেওয়া হয়েছিল। কাগজপত্র যাচাই করে শুল্ক গোয়েন্দারা দেখেছেন, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের বিল অব এন্ট্রি-১০৪৫৯১১, তারিখ ১৩/১২/২০১১-এ ১৩০% শুল্ক দিয়ে ভোলা থেকে রেজিস্ট্রেশন করা হয়। কাস্টম হাউসের নথি যাচাই করে এই বিল অব এন্ট্রি ভুয়া হিসেবে প্রমাণ পাওয়া গেছে। পাবনার ফারুকুজ্জামান চৌধুরী নামের এক ব্যক্তির নামে রেজিস্ট্রেশন হওয়া গাড়িটি মুসা বিন শমসের ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করতেন। ফারুকুজ্জামান মুসা বিন শমসের শ্যালক।
দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে শুল্ক গোয়েন্দার মোহাম্মদ জাকির হোসেন গুলশান থানায় মুসার বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে ২ কোটি ১৫ লাখ ৬৫ হাজার ৮৩৩ টাকা শুল্ক কর ফাঁকির অভিযোগ আনা হয়।

শুল্ক গোয়েন্দা শুল্ক ফাঁকির মামলা করলেও ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে বিআরটিএ কর্মকর্তার ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিক্রয়নিষিদ্ধ গাড়ির রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম দুদকের তফসিলভুক্ত হওয়ায় বিষয়টি অনুসন্ধানে দুদকে পাঠানো হয়।

অনুসন্ধানে দুদক দেখেছে, ভুয়া রেকর্ডপত্রের মাধ্যমে মুসা বিন শমসের তাঁর শ্যালক ফারুকুজ্জামান চৌধুরীর নামে গাড়িটি রেজিস্ট্রেশন করিয়েছেন। দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে ফারুকুজ্জামান চৌধুরী বলেন, তিনি শুধু রেজিস্ট্রেশনের সময় ভোলায় গিয়েছিলেন। মুসা বিন শমসের শ্যালকের সঙ্গে গাড়ি ভাড়ার চুক্তিপত্র প্রদর্শন করলেও ফারুকুজ্জামান সেই চুক্তির বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানান। দুদকের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ফরিদ নাবিরের কার্নেট ডি প্যাসেজ সুবিধায় বিনা শুল্কে আনা গাড়িটি মুসা বিন শমসের মেসার্স অটো ডিফাইন থেকে ফারুকুজ্জামান চৌধুরীর নামে কিনে ভোলা বিআরটিএ থেকে রেজিস্ট্রেশন করান।

অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে, রেজিস্ট্রেশনে যেসব কাগজপত্র দেওয়া হয়েছে, তার সব কটি জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করা। এসব ভুয়া কাগজপত্র ভোলা বিআরটিএর সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিন) মো. আইয়ুব আনছারীর সহযোগিতায় রেজিস্ট্রেশন করিয়েছেন। এর মাধ্যমে আসামিরা ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে প্রতারণা ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে ফৌজদারি অপরাধ করেছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা ও দণ্ডবিধির ৪২০ ও ১০৯ ধারায় মামলা করা হয়েছে।