নিয়মের মধ্যে অনিয়ম

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। ফাইল ছবি
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। ফাইল ছবি

প্রাথমিক শিক্ষার উপবৃত্তির টাকা বিতরণের জন্য সেবা মাশুল (সার্ভিস চার্জ) বাড়িয়ে প্রায় ছয় কোটি টাকা বাড়তি আদায় করা হয়েছে। সেই টাকায় প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, রূপালী ব্যাংক ও উপবৃত্তি প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ১২ জন এক দফা বিদেশ সফর করেছেন, আরেক দফা সফরের প্রস্তুতি চলছে।

এ ছাড়া প্রণোদনা (সম্মানী) এবং প্রশিক্ষণের টাকাও খরচ হচ্ছে বাড়তি সেবা মাশুল থেকে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব, মহাপরিচালক, প্রকল্প পরিচালক থেকে শুরু করে গাড়ির চালক পর্যন্ত এই সম্মানী পেয়েছেন, যার পরিমাণ ছয় হাজার টাকা থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত। তাঁদের অনেকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাজের সম্পর্ক নেই। 

প্রকল্প ও রূপালী ব্যাংকের নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, উপবৃত্তি প্রকল্প এবং রূপালী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যোগসাজশে নিয়মের মধ্যে এই অনিয়ম করেছেন। এর অংশ হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে রূপালী ব্যাংকের সেবা মাশুল দেড় শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২ শতাংশ করা হয়েছে। তাতে বাড়তি আয় হয়েছে প্রায় ছয় কোটি টাকা।

প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তার ও মান উন্নয়নে শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি দেয় সরকার। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে উপবৃত্তি প্রকল্পের এখন তৃতীয় পর্যায় চলছে, যার মেয়াদ আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত। উপবৃত্তির সুবিধাভোগী শিক্ষার্থী প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ। শ্রেণিভেদে শিক্ষার্থীদের ৫০ টাকা থেকে শুরু করে ৩০০ টাকা (চার শিক্ষার্থীর পরিবার) পর্যন্ত উপবৃত্তি দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের মায়েদের নামে খোলা হিসাবে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এই টাকা পাঠানোর দায়িত্ব পালন করে রূপালী ব্যাংকের ‘শিওর ক্যাশ’। এ জন্য তারা দেড় শতাংশ সার্ভিস চার্জ নিচ্ছিল, যা গত বছর ২ শতাংশ করা হয়। প্রতিবছর প্রায় ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকার উপবৃত্তি দেওয়া হয়। শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ সার্ভিস চার্জ বাড়ানোর ফলে সেবা মাশুল প্রায় ছয় কোটি টাকা বেশি আয় হয়। 

নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, উপবৃত্তি প্রদান প্রকল্পের প্রস্তাবে (ডিপিপি) বিদেশ সফরসহ এসব সুবিধার কথা ছিল না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপবৃত্তি প্রকল্পের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মূলত সেবা মাশুল বাড়িয়ে কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর, ‘ডেটা আপলোড ও ম্যানেজমেন্ট’ নামে সম্মানী নেওয়া এবং প্রশিক্ষণের টাকা যুক্ত করা হয়েছে। 

প্রকল্পের প্রশিক্ষণের টাকা ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়েও অভিযোগ উঠেছে। কার্যত সরকারের টাকা কৌশল করে ব্যাংকের নামে দেওয়া হচ্ছে। এখানে ব্যাংকও লাভবান হচ্ছে। কারণ, এই তিন খাতে যে টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, বর্ধিত সেবা মাশুল আদায় হচ্ছে তার চেয়েও বেশি।

অবশ্য সেবা মাশুল বাড়িয়ে সেই টাকায় বিদেশ সফর করার অভিযোগ নাকচ করেন প্রকল্প পরিচালক মো. ইউসুফ আলী। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, দরপত্রের মাধ্যমে রূপালী ব্যাংককে কাজ দেওয়া হয়েছিল। বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম (সিএসআর) তহবিল থাকে। সেখান থেকে তারা বিভিন্ন বিষয়ে উৎসাহব্যঞ্জক কাজ করে থাকে। সচিব, ডিজি, প্রকল্প পরিচালকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘সম্মানী’ নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, তাঁরা সবাই প্রকল্পের কাজে কোনো না কোনোভাবে জড়িত ছিলেন। 

তবে ব্যাংকের সেবা মাশুল বাড়িয়ে সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে রূপালী ব্যাংকের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) কাওসার মুস্তাফিজ ২ অক্টোবর প্রথম আলোকে বলেন, চুক্তিপত্র অনুযায়ী সবকিছু করা হয়েছে। চুক্তির বাইরে অনৈতিক কিছুই করা হয়নি। তাঁর দাবি, আগে সার্ভিস চার্জ বেশি ছিল, পরে কমেছে। এরপর খরচ বেড়ে যাওয়ায় তাঁরা সেবা মাশুল আরও বেশি চেয়েছিলেন। কিন্তু যতটা চাওয়া হয়েছিল, ততটা দেওয়া হয়নি।

সম্মানীর টাকা সচিব থেকে চালক পর্যন্ত

তিন বছর ধরে রূপালী ব্যাংকের শিওর ক্যাশের মাধ্যমে টাকা দেওয়া হচ্ছে। প্রথম বছর (২০১৬-১৭ অর্থবছর) শিক্ষার্থীদের হিসাব খুলতে কেওয়াইসি ফরম পূরণ করতে খরচ বেশি হওয়ায় সেবা মাশুল ২ শতাংশ হারে দেওয়া হয়। কাজ কমে যাওয়ায় পরে তা দেড় শতাংশ করা হয়। কিন্তু ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এসে কাজ না বাড়লেও সেবা মাশুল আবার ২ শতাংশ করা হয়। প্রকল্পের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কিছু কর্মকর্তা ব্যক্তিগত লাভের জন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ছয় কোটি টাকা বাড়তি আদায় করে। 

রূপালী ব্যাংকের সঙ্গে করা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের চুক্তিতে ‘ডেটা আপলোড ও ম্যানেজমেন্ট’–এর নামে প্রণোদনা হিসেবে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা রাখা হয়। ‘শিওর ক্যাশ সম্মানী বাবদ’ প্রকল্পের কর্মকর্তা ছাড়াও মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সম্মানী দেওয়া হয়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগের সচিবের নামে বরাদ্দ করা হয় দেড় লাখ টাকা। অতিরিক্ত সচিবের (উন্নয়ন) জন্য ১ লাখ ২০ হাজার টাকা, যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) ও যুগ্ম প্রধানের (পরিকল্পনা) জন্য ৮০ লাখ টাকা করে বরাদ্দ করা হয়। এ ছাড়া নিচের পদের আরও ১৩ জনকে ৮ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা দেওয়া হয়। অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের জন্য অতিরিক্ত সচিবের সমান ও প্রকল্প পরিচালকের জন্য যুগ্ম সচিবের সমান টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। বর্তমানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষাসচিব মো. আকরাম-আল-হোসেন এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এফ এম মনজুর কাদির এবং প্রকল্পের পরিচালক মো. ইউসুফ আলী।

বিদেশ সফর 

প্রকল্প, অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ছাড়াও রূপালী ব্যাংকের তিনজন কর্মকর্তাকে বিদেশ সফরের জন্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ জন্য খরচ ধরা হয় সর্বোচ্চ ১ কোটি ৩ লাখ টাকা। এই চুক্তির অধীনে ১২ জন কর্মকর্তা গত জুনে ইউরোপের তিনটি দেশ নেদারল্যান্ডস, ফিনল্যান্ড ও সুইডেন ঘুরে এসেছেন। এই সফরে থাকা কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব, অতিরিক্ত সচিব (বর্তমানে বিআরডিবির চেয়ারম্যান) মো. গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এফ এম মঞ্জুর কাদির, উপবৃত্তি প্রকল্পের পরিচালক মো. ইউসুফ আলী। তখন ব্যাংকের তিন কর্মকর্তাও গিয়েছিলেন। এ নিয়ে বিতর্কের মধ্যে আগামী মাসে ১০ জন করে দুটি দলের অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড এবং আফ্রিকায় সফরে যাওয়ার কথা রয়েছে। জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন যে যেভাবে পারছে, সেভাবেই সুযোগ-সুবিধা ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। এটা খুবই দুঃখজনক ও লজ্জার কথা। এসব অনিয়ম বন্ধ করতে হবে।’

প্রতিবেদন তৈরি করেছেন মোশতাক আহমেদ, ঢাকা, আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ, রাজশাহী ও মাসুদ আলম, যশোর