চিকিৎসাশিক্ষায় সাফল্যের ধারায় সিলেট

ক্লাস শেষে বেরিয়ে আসছেন শিক্ষার্থীরা। সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে সম্প্রতি।  ছবি: আনিস মাহমুদ
ক্লাস শেষে বেরিয়ে আসছেন শিক্ষার্থীরা। সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে সম্প্রতি। ছবি: আনিস মাহমুদ

৫০ বছর আগে সিলেটে বসে চিকিৎসাশিক্ষা সম্পন্ন ছিল অনেকটা স্বপ্নের মতো। সেই স্বপ্ন এখন নাগালে। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে এগিয়ে গেছে চিকিৎসাশিক্ষা। সেই সঙ্গে প্রসার ঘটছে চিকিৎসাসেবারও। এখন সিলেটকে এ খাতে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ এসেছে। এ নিয়ে বিশেষ আয়োজন। লিখেছেন উজ্জ্বল মেহেদী ও সুমনকুমার দাশ

আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে ভর্তি কার্যক্রম শুরুর প্রস্তুতিতে রয়েছে নবপ্রতিষ্ঠিত মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

সিলেটে চিকিৎসাশিক্ষার ইতিহাস সুপ্রাচীন নয়। ৫০ বছর আগেও ছিল দৈন্য। ‘মেডিকেল স্কুল’ থেকে কলেজে রূপ নেওয়া প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসাশিক্ষার ভিত্তি আর কাঠামো দুটোই ছিল নড়বড়ে। সেই অবস্থা কাটিয়ে অনন্য এক উচ্চতার দিকে যাত্রা শুরু করেছে সিলেটের মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থা। সরকারি মেডিকেল কলেজ বিভাগীয় শহর থেকে ছড়িয়ে পড়ছে জেলা শহরে। দীর্ঘ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করায় সিলেট এখন চিকিৎসাশিক্ষায় সাফল্যের ধারায়।

একসময় সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজই ছিল সিলেটে চিকিৎসাশিক্ষার একমাত্র প্রতিষ্ঠান। ১৯৬২ সালে কলেজ হওয়ার তিন দশক পর ১৯৯৫ সালে জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ নামে একটি বেসরকারি কলেজ স্থাপিত হয়। পরবর্তী দুই থেকে তিন দশকের মধ্যে এরপর আরও তিনটি বেসরকারি ও একটি সরকারি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে ভর্তি কার্যক্রম শুরুর প্রস্তুতিতে রয়েছে নবপ্রতিষ্ঠিত মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি মেডিকেল কলেজ। সব মিলিয়ে প্রায় আড়াই দশকের ব্যবধানে সিলেটের মেডিকেল শিক্ষায় এক অভাবনীয় সাফল্য এসেছে।

মেডিকেল শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেবল কলেজ-পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দিক থেকেই শুধু অগ্রসরমাণ নয় সিলেট, চিকিৎসাশিক্ষায়ও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে এখন অনেক বেশি অগ্রসর হওয়ার পথে রয়েছে। প্রচুরসংখ্যক বিদেশি শিক্ষার্থীও এখানকার মেডিকেল কলেজগুলোতে পড়াশোনা করতে আগ্রহী হচ্ছেন। অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় মোটামুটিভাবে এখানকার কলেজগুলোর অবকাঠামোসুবিধাও ভালো। এ ছাড়া শিক্ষক-সংকটও সে অর্থে নেই। এর ফলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায়ও কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে না।

এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ সিলেটের সবচেয়ে বড় মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এমবিবিএস ডিগ্রি প্রদান থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরিতে এ প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এখানে বর্তমানে ১ হাজার ৫০০ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। প্রথম বেসরকারি মেডিকেল কলেজ জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ চিকিৎসাশিক্ষায় ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসে। এই ধারায় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৮ সালে নগরের তেলিহাওর এলাকায় (বর্তমানে দক্ষিণ সুরমা) নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ। সর্বশেষ ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় পার্ক ভিউ মেডিকেল কলেজ।

শুধু নারীদের জন্য আলাদা করে মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা হয় বেসরকারি উদ্যোগে। ২০০৫ সালে ‘হলি সিলেট হোল্ডিং লিমিটেড’ নগরের মীরবক্সটুলা এলাকায় সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করে। প্রতিষ্ঠানটি পাঁচ বছর মেয়াদি ব্যাচেলর অব মেডিসিন ও ব্যাচেলর অব সার্জারি (এমবিবিএস) ডিগ্রি দিয়ে থাকে। বর্তমানে এ কলেজটিতে ৫২০ জন ছাত্রী পড়াশোনা করছেন।

বেসরকারি মেডিকেল কলেজের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, মেডিকেল শিক্ষা সাধারণ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা থেকে একেবারেই ভিন্ন। পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষকদের দ্বারা হাতে-কলমে পাঠদান নিশ্চিত না হলে স্নাতক পর্যায়ের চিকিৎসক গড়ে তোলা সম্ভব নয়। সে জন্য সিলেটের মেডিকেল কলেজগুলোয় শিক্ষার্থীদের চাহিদার কথা বিবেচনায় রেখে ছাত্র ও শিক্ষক অনুপাত যথাযথ রাখার চেষ্টা সব সময় করা হয়। এটি জানতে পেরেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মেডিকেল ভর্তি–ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা সিলেটের মেডিকেল কলেজগুলোকে বেছে নেন।

২০১৭ সালে হবিগঞ্জ জেলায় সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ। ২০১৮ সালের ১০ জানুয়ারি এ কলেজের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। হবিগঞ্জ পৌর এলাকায় অবস্থিত হাসপাতাল ভবনের পঞ্চম তলায় অস্থায়ীভাবে কলেজের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. আবু সুফিয়ান জানান, কলেজটিতে বর্তমানে ৫০ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন।

২০১৯ সালের এপ্রিলে সুনামগঞ্জেও সরকারিভাবে ‘বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ’ স্থাপন প্রকল্প যাত্রা করে। কলেজের প্রকল্প পরিচালক দায়িত্বে আছেন সুনামগঞ্জের সিভিল সার্জন আশুতোষ দাশ। তিনি জানান, ৩৫ একর জায়গার ওপর সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার মদনপুরে কলেজ নির্মাণের কাজ দ্রুতগতিতে চলছে। ২০২০ শিক্ষাবর্ষ থেকে এ কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে।

আর সর্বশেষ অর্জন যেন সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। সিলেট অঞ্চলের চিকিৎসক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা জানান, দীর্ঘদিন ধরেই সিলেটবাসীর দাবি ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের। এ জনদাবিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও সেবার মান এবং বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে জাতীয় সংসদে বিল পাস হয়। সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। এখনো শিক্ষার্থী ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়নি। তবে দ্রুত অবকাঠামোসুবিধা নিশ্চিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে সংশ্লিষ্টদের। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য নিযুক্ত হয়েছেন মোর্শেদ আহমেদ চৌধুরী। তিনি সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ পদ থেকে উপাচার্য মনোনীত হয়েছেন।

মোর্শেদ আহমেদ চৌধুরী মনে করেন, সিলেট এখন চিকিৎসাশিক্ষায় সাফল্যের ধারায়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর শিক্ষাক্ষেত্রে যে পরিবর্তন সূচিত হয়, মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থায় এই বিশ্ববিদ্যালয় ঠিক সেই রকম পরিবর্তনের সূচনা করবে। চিকিৎসাশিক্ষায়, সেবায় ও গবেষণায় নতুন দুয়ার উন্মোচিত হওয়ার শুভক্ষণে এখন সিলেট।