গণপূর্তে ঠিকাদারির এক-তৃতীয়াংশ কাজ শামীমের হাতে

জি কে শামীম। প্রথম আলো ফাইল ছবি
জি কে শামীম। প্রথম আলো ফাইল ছবি

সারা দেশে চলমান গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রকল্পগুলোর মধ্যে প্রায় এক–তৃতীয়াংশের নির্মাণ–কাজ একক ও যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছিল গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীমের মালিকানাধীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। পূর্ত ভবনের প্রভাবশালী এই ঠিকাদার যুবলীগের স্বঘোষিত সমবায়বিষয়ক সম্পাদক। বর্তমানে তিনি মাদক ও অস্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে। তাঁর ব্যাংক হিসাবও জব্দ করা হয়েছে। ফলে বেশির ভাগ প্রকল্পের কাজ স্থবির হয়ে পড়েছে।

সচিবালয়ের নতুন ভবন, ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়, গাজীপুরে র্যাবের কমপ্লেক্স, আজিমপুরে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য বহুতল ভবন নির্মাণসহ এককভাবে সরকারের ১৩টি বড় প্রকল্পের ঠিকাদার জি কে শামীম। এসব প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়েও তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।

এই অবস্থায় প্রকল্পগুলোর কাজ এগিয়ে নেওয়ার জন্য শামীমের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে নতুন ঠিকাদার নিয়োগের কথা ভাবছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণের জন্য অধিদপ্তরকে ইতিমধ্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যদি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ এগিয়ে নিয়ে যায় ভালো। না হলে বিধিমোতাবেক তাদের (শামীমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান) সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি বাতিল করে অন্য ঠিকাদার নিয়োগ করা হবে। যদি তারা ১০ তলা ভবনের দোতলা পর্যন্ত করে থাকে, তাহলে দোতলা পর্যন্ত জরিপ করে কত টাকা তিনি ব্যয় করেছেন, তা নিরূপণ করে বাকি অংশের জন্য আবার দরপত্র আহ্বান করে অন্য ঠিকাদার নিয়োগ করা হবে।

একই প্রতিষ্ঠান এতগুলো প্রকল্পের কাজ কীভাবে পেল, এমন প্রশ্নের জবাবে গণপূর্তমন্ত্রী বলেন, ‘তখন আমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলাম না। তবে জেনেছি, এসব প্রকল্পের জন্য ই-টেন্ডার পদ্ধতিসহ অন্যান্য পদ্ধতিতে দরপত্রে অংশ নিয়েছে জিকেবি। সর্বনিম্ন দরদাতা বিবেচনা করেই তাদের কাজ দেওয়া হয়েছে।’

গণপূর্ত অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত ঠিকাদারের সংখ্যা দুই হাজারের মতো। আর এই মুহূর্তে সারা দেশে চলমান প্রকল্পের সংখ্যা ১৯৪। এর মধ্যে এককভাবে শামীমের প্রতিষ্ঠান জিকেবি অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড ১৩টি প্রকল্পের নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করছে। আবার একই প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে আরও ৪২টি প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত, যা সারা দেশে চলমান অধিদপ্তরের মোট প্রকল্পের ২৮ শতাংশ। সবকটি প্রকল্পের চুক্তিমূল্য ৪ হাজার ৬৪২ কোটি ২০ লাখ টাকা। যার মধ্যে ১ হাজার ৩০১ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। আর সব মিলিয়ে জিকেবির এককভাবে করা প্রকল্পগুলোর গড় ভৌত অগ্রগতি ৬৮ শতাংশ। বিপরীতে যৌথভাবে করা প্রকল্পগুলোর ভৌত অগ্রগতি ৪২ শতাংশ।

এসব প্রকল্পের ২৩টির অনুমোদন দিয়েছে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। ১৮টি প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। ১০ প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী। এ ছাড়া অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী তিনটি ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী একটি প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছেন।

>

৪,৬৪২ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে শামীমের প্রতিষ্ঠান
কাজ শেষ না হলেও ১,৩০০ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে

অবশ্য গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সাহাদাত হোসেনের ভাষ্য, চুক্তি বাতিল করে নতুন করে কাজ শুরু করার বিষয়টি সময়সাপেক্ষ। তিনি বলেন, যদি কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান একনাগাড়ে ২৮ দিন কাজ বন্ধ রাখে, তাহলে তাদের চুক্তি বাতিলের নোটিশ দেওয়া যায়। এরপরও যদি তারা কাজ শুরুর পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে প্রকল্পের কাজ কতটুকু সম্পন্ন হয়েছে তা নিরূপণ করা হবে। সেই সঙ্গে যতটুকু কাজ শেষ হয়নি তার পরিমাণ ও আর্থিক মূল্যও নির্ধারণ করা হবে। এরপর তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পেলেই পুনরায় দরপত্র প্রক্রিয়ায় যাওয়া সম্ভব।



জি কে শামীম নিজের পরিচয় দিতেন ‘নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সমবায়বিষয়ক সম্পাদক’ হিসেবে। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের মধ্যে গত ২০ সেপ্টেম্বর শামীম গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকেই তাঁর হাতে থাকা বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ থমকে যায়। গত সোমবার ঢাকায় জিকেবির একক ও যৌথভাবে চলা নয়টি প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখেন এই প্রতিবেদক। এর মধ্যে সাতটি প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি বন্ধ আছে। যৌথ অংশীদারত্বের দুটি প্রকল্পের কাজ চলছে ঢিমেতালে। প্রকল্প এলাকায় উপস্থিত প্রকৌশলী ও অন্য ব্যক্তিরা জানান, মূলত শামীম গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকেই এই অচলাবস্থা শুরু হয়েছে। প্রথম দু–এক দিন তাঁরা কাজ চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেও পরে টাকার অভাবে তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এখন শ্রমিকের দৈনিক মজুরি দেওয়ার মতো অবস্থাও তাঁদের নেই।

আগারগাঁওয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ভবন এবং ন্যাশনাল নিউরো সায়েন্স ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের একটি ভবন যৌথভাবে নির্মাণ করছে জিকেবি অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড এবং পিএইএল (জেভি)। সোমবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, পাশাপাশি নির্মাণাধীন দুটি ভবনে অল্প কিছু শ্রমিক কাজ করছেন। এর মধ্যে নির্মাণাধীন ১২ তলা রাজস্ব ভবনের নিচতলায় অবস্থিত জিকেবির সাইট অফিসে কথা হয় প্রকল্প প্রকৌশলী নাজমুল হাসানের সঙ্গে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, প্রকল্পের প্রায় ৬০ শতাংশ কাজ শেষ। এ অবস্থায় ২৫ সেপ্টেম্বরের পর থেকে প্রায় ১৫ দিন কাজ বন্ধ ছিল। এখন আবার কাজ শুরু হলেও সামগ্রিক পরিস্থিতিতে গতি অনেক ধীর।

একই এলাকায় নির্মাণাধীন ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে কথা হয় নিরাপত্তাপ্রহরী বুলবুল আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এক বছর ধরে এই জায়গার কাজ বন্ধ। কিন্তু আমি প্রতিদিন ৩০০ টাকা করে পাইতাম। এখন সেটাও পাচ্ছি না।’ এ ছাড়া জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান এবং সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে দুটি আলাদা প্রকল্পের কাজও বন্ধ ছিল। এর মধ্যে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ছয়টি ইউনিটে ১ লাখ ৮ হাজার বর্গফুট জায়গার নির্মাণকাজ করছে জিকেবি। প্রকল্পের প্রকৌশলী কামরুজ্জামান খান বলেন, ‘প্রতিদিন কাজ চালানোর জন্য ১০ লাখ টাকা লাগে। প্রায় ৬০০ শ্রমিক কাজ করে। টাকা নাই, তাই কাজও নাই।’

এদিকে বেইলি রোডে পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্পের চারটি অংশের কাজ করছে জিকেবি। সেখানে গিয়েও একজন নিরপত্তাপ্রহরী ছাড়া আর কারোর দেখা মেলেনি।

জিকেবি অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেডের অন্য প্রকল্পগুলোর বিষয়ে কথা বলার জন্য যোগাযোগ করা হয় প্রতিষ্ঠানটির প্রধান প্রকৌশলী এবং গণপূর্ত অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. গোলাম মুস্তাফার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি এ ব্যাপারে কথা বলতে আগ্রহী না। কিছু জানার থাকলে গণপূর্ত অধিদপ্তরে যোগাযোগ করেন।’

এককভাবে জিকেবি ও যৌথ অংশীদারত্বের মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন ৫৫টি প্রকল্পের মধ্যে ২৭টি প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি। পাঁচ বছর আগে শেষ হওয়ার কথা এমন প্রকল্পও এর মধ্যে আছে। আবার চলতি বছরে শেষ করতে হবে এমন একটি প্রকল্পের কাজ শুরুই হয়নি। জি কে শামীমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নির্মাণাধীন প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরের তৈরি একটি তালিকা বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। তালিকা অনুসারে ২০১৯ সালে শেষ হওয়ার কথা এমন ১৯টি প্রকল্পের নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেছে।

নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়া এসব প্রকল্প যদি নতুন কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পুনরায় শুরু করতে যায়, তাহলে প্রকল্প ব্যয় বাড়বে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সাহাদাত হোসেন বলেন, এ ক্ষেত্রে প্রকল্প ব্যয় বাড়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়।

সার্বিক বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, একটা প্রতিষ্ঠানের হাতে এতগুলো কাজ গেলে সেটা বোঝা হয়ে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। এক ঝুঁড়িতে সবগুলো ডিম কেন রাখতে হবে? এটা অনিয়ম।’