সবজির চারায় দিনবদল

আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামি নামি করছে। কৃষকেরা মাঠ থেকে বাড়ির দিকে দৌড়াচ্ছেন। আবার কিছু কৃষক বাড়ি থেকে জমির দিকে ছুটছেন। রোপণ করা চারার ওপর পলিথিনের ছাউনি টেনে দিলেন। জমির পাশে জমা হওয়া পানিও সরাতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন কয়েকজন। ঘণ্টাখানেক ধরে বৃষ্টি চলল। সবজির চারা রোপণকারী কৃষকেরা মাঠ ছাড়লেন না। বৃষ্টি থামার পর সযত্নে সরিয়ে দিলেন পলিথিনের আচ্ছাদন।

এগুলো সবজির চারা। আর সব ফসলের চেয়ে বিশেষ যত্নআত্তি করতে হয় এগুলোকে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পরিবারের সবাইকে লেগে থাকতে হয় এর পেছনে। কখন বৃষ্টি হলো, রোদ নামল, পোকায় আক্রমণ করল, তা খেয়াল রাখতে হয়। চারাগুলো রক্ষায় নিতে হয় বিশেষ ব্যবস্থা। বীজ থেকে চারা উৎপাদনের কষ্টসহিষ্ণু কাজটি করে যাচ্ছে যশোর সদর উপজেলার আবদুলপুর গ্রামের ৬৫টি পরিবার। ওই গ্রামের ২৫ একর জমিতে শুধু সবজির চারাই করা হয়। বছর বিশেক আগে আরশাদ আলী মোড়ল (৬৫) সবজির চারা উৎপাদনের এই কাজ শুরু করেন। ধীরে ধীরে তা আরও অনেকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। একসময়ের দরিদ্র পরিবারগুলো সচ্ছলতার মুখ দেখে। চারাচাষিদের ওপর ভরসা করে অনেকে বীজের ব্যবসায় নামেন। চারা বেচাকেনা করতে আবদুলপুরে গড়ে উঠেছে বাজার। ভ্যানে চারা পরিবহন করে অনেকে দিন গুজরান করেন। এককথায়, আবদুলপুরের অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছেন এই চারাচাষিরা।

যশোর সদর থেকে চুয়াডাঙ্গা সড়ক ধরে ১২ কিলোমিটার এগোলে আবদুলপুর গ্রাম। ওই সড়কের এক পাশে বসতবাড়ি, অন্য পাশে ফসলি জমি। সম্প্রতি ওই গ্রামে গিয়ে ৬৫ কৃষকের ভিন্নধর্মী চাষবাস দেখা গেল। অন্যরা যখন আমন ধান ও শীতের আগাম সবজি নিয়ে ব্যস্ত, তখন ওই পরিবারগুলো ব্যস্ত সবজির চারা নিয়ে।

শীতকালীন সবজি বাঁধাকপি ও ফুলকপির বীজ থেকে চারা উৎপাদনে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকেরা। সম্প্রতি যশোর সদর উপজেলার আব্দুলপুর গ্রামে ।  ছবি: এহসান-উদ-দৌলা
শীতকালীন সবজি বাঁধাকপি ও ফুলকপির বীজ থেকে চারা উৎপাদনে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকেরা। সম্প্রতি যশোর সদর উপজেলার আব্দুলপুর গ্রামে । ছবি: এহসান-উদ-দৌলা

কথা হয় জমির পাশে দাঁড়ানো কৃষক আরশাদ আলী মোড়লের সঙ্গে। এই কৃষকই আবদুলপুর গ্রামে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রথম বীজ থেকে চারা উৎপাদন শুরু করেন। বাবার কাছ থেকে চারা উৎপাদনের পদ্ধতি শিখেছিলেন। তাঁর তিন মেয়ে মিনা, পুতুল ও বীথির বিয়ে হয়ে গেছে। বিয়ের আগে তাঁরা বাবাকে সাহায্য করতেন। এখনো স্বামীর বাড়ি থেকে প্রায়ই বাবাকে সহযোগিতা করতে আসেন। আরশাদের স্ত্রী আহারুন নেছাও চারা উৎপাদনে গ্রামের মধ্যে অভিজ্ঞ কিষানি হিসেবে পরিচিত। তাঁর কাছ থেকেও অন্যরা পরামর্শ নেন।

গ্রামের প্রবীণ কৃষকেরা জানান, বছর বিশেক আগে আরশাদ আলী মোড়ল সবজির চারা উৎপাদন শুরু করেন। পরে তাঁর সঙ্গে যোগ দেন ওই গ্রামেরই কৃষক আবদুর রাজ্জাক ও জাকির হোসেন। একসময়ের দারিদ্র্যকবলিত ওই এলাকায় আশার আলো দেখা দেয়। লাভের মুখ দেখে অন্য কৃষকেরাও চারা উৎপাদনে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। ক্রমে বাড়তে থাকে চারা উৎপাদনের জমির পরিমাণ। বছরের আট মাসে চারবার জমিতে চারা করেন এখানকার কৃষকেরা। মুলা, বেগুন, শিম, বরবটি, পটোল, ফুলকপি, বাঁধাকপি থেকে শুরু করে বিভিন্ন জাতের শাকসবজির চারা উৎপাদন করেন তাঁরা।

চারা উৎপাদনের ওই জমিগুলোর পাশে দাঁড়িয়েই দেখা গেল, আশপাশের গ্রাম তো বটেই, উপজেলার সীমানা ছাড়িয়ে আশপাশের জেলা থেকেও কৃষকেরা আসছেন চারা নিতে। প্রতিটি চারা ৪০ থেকে ৬০ পয়সা দরে বিক্রি হচ্ছে। পাশের জেলা চুয়াডাঙ্গা, নড়াইল, সাতক্ষীরা ও খুলনা থেকে চাষিরা সেখানে চারা কিনতে আসছেন। প্রতিদিন ভোর পাঁচটা থেকে সকাল সাড়ে সাতটা পর্যন্ত সেখানে চারা বিক্রির হাটও বসে। জমিগুলোর পাশে ছোট্ট একটি বাজার, বীজের দোকান, ভ্যান রাখার স্ট্যান্ড আর কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের একটি বিপণন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে।  

যশোর জেলা সদরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা জাকির হোসেন জানান, ওই গ্রামে জুন থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, অর্থাৎ ৮ থেকে ৯ মাস চারা উৎপাদন হয়। বছরে সেখানে প্রায় ২০ কোটি চারা হয়, যার বাণিজ্যিক মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। গ্রামীণ ওই দরিদ্র জনপদের চেহারাই বদলে দিয়েছে সবজির চারা। তাঁদের দেখাদেখি গ্রামের অন্যরা কেন ওই চারা উৎপাদন করেন না, কেন ৬৫ জনই করেন—জানতে চাইলে কৃষি কর্মকর্তা বলেন, চারা উৎপাদনের কাজটি অনেক সময় ও শ্রমসাধ্য কাজ। মূলত পরিশ্রমী ও দক্ষ কৃষকেরাই তা করতে পারেন। কারণ, যেকোনো সময় বৃষ্টি বা রোদে বা কোনো অবহেলার কারণে চারাগুলো নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ওই ৬৫ কৃষক পুরো পরিবারকে যুক্ত করে তা করেন। ফলে তাঁরা সফল হয়েছেন।

তবে স্থানীয় কৃষকেরা ওই গ্রামের ২৫ একর জমিতে ভালো চারা হওয়ার আরেকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। তাঁরা বলছেন, গ্রামের অন্য জমিতে বালুর পরিমাণ কম। চারা উৎপাদনের জমিতে বালু বেশি, অর্থাৎ দোআঁশ মাটি। ফলে সেখানে বেশিক্ষণ পানি ও তাপ জমে থাকে না। এই সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে কৃষকেরা চারা উৎপাদনে নামেন।