রোহিঙ্গা সংকট: সঞ্চয় ভেঙেছেন ২৮% স্থানীয় মানুষ

দুই বছর আগেও এই জমিতে ধান ও লবণ উৎপাদন করতেন স্থানীয় চাষিরা। এসব জমিতে রোহিঙ্গারা বসতি স্থাপন করায় আর কোনো ধরনের চাষাবাদ করা সম্ভব হচ্ছে না। গতকাল বিকেলে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের মোচনী গ্রামে।  ছবি: প্রথম আলো
দুই বছর আগেও এই জমিতে ধান ও লবণ উৎপাদন করতেন স্থানীয় চাষিরা। এসব জমিতে রোহিঙ্গারা বসতি স্থাপন করায় আর কোনো ধরনের চাষাবাদ করা সম্ভব হচ্ছে না। গতকাল বিকেলে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের মোচনী গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

রোহিঙ্গাদের কারণে কক্সবাজার জেলার বনভূমি, সুপেয় পানির উৎস ও কৃষিজমি যেমন ধ্বংস হচ্ছে, তেমনি স্থানীয় মানুষের জন্য শুধু খাদ্যঝুঁকিও তৈরি করেছে। টিকে থাকার তাগিদে জেলার টেকনাফ ও উখিয়ার স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ২৮ শতাংশ সঞ্চয় ভেঙেছেন, অনেকে গয়নাও বিক্রি করে দিয়েছেন। রোহিঙ্গারা তুলনামূলকভাবে সস্তায় শ্রম বিক্রি করায় দিনমজুরির কাজেও পিছিয়ে পড়ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

১৫ অক্টোবর প্রকাশিত ‘বৈশ্বিক খাদ্যসংকট প্রতিবেদন-২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বৈদেশিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউনিসেফসহ মোট আটটি আন্তর্জাতিক সংস্থা যৌথভাবে প্রতিবেদনটি করেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এই প্রতিবেদনের ভূমিকা লিখেছেন।

প্রতিবেদনের ভূমিকায় জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ, অর্থনৈতিক সংকট ও যুদ্ধ-সংঘাত বিশ্বের দারিদ্র্যকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এসব সংকট মোকাবিলায় একসঙ্গে লড়াই করতে হবে। দারিদ্র্য দূর করার সংগ্রামে সবাইকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।

প্রতিবেদনে কক্সবাজারের স্থানীয় ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের খাদ্য ও অন্যান্য সহায়তা দিচ্ছে। শিবিরে আসার পর ৯১ শতাংশ রোহিঙ্গার খাদ্য পরিস্থিতি আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গারা আসার পর স্থানীয়দের খাবার কেনার সামর্থ্য কমে গেছে। প্রতি ১০টি পরিবারের মধ্যে ৭টি পরিবারের খাদ্য কেনার সামর্থ্য কমে গেছে। সামগ্রিকভাবে দুই উপজেলার ৪৮ শতাংশ স্থানীয় জনগোষ্ঠীর হাতে খাবার কেনার মতো যথেষ্ট অর্থ নেই। উখিয়া ও টেকনাফের জনসংখ্যা সাড়ে ৫ লাখের কিছু বেশি। আর রোহিঙ্গারা রয়েছে প্রায় ১১ লাখ।

টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শিবিরের পাশের মুছুনি গ্রামের বাসিন্দা নবী হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর চার বিঘা ফসলি জমিতে রোহিঙ্গারা ২২টি ঘর তুলেছে। মানবতার কারণে ঘর তুলতে প্রথমে তিনি বাধা দেননি। পরে রোহিঙ্গারা সেখানে মোট ৩৫টি ঘর তোলে। প্রথম কয়েক মাস রোহিঙ্গারা মাসে ৫০০ টাকা করে ভাড়া দিত তাঁকে। পরে আর তারা ভাড়া দেয় না। আবার জমিও ছাড়ে না। ওই জমিতে তিনি ধান ও লবণ চাষ করতেন। এ অবস্থায় আর্থিক সংকটে রয়েছেন তিনি।

>

কক্সবাজারের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সংকটের বিষয়টি উঠে এসেছে ‘বৈশ্বিক খাদ্যসংকট প্রতিবেদন-২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদনে

টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের জাদিমুড়া, মুছুনি, নয়াপড়া, লেদা, দমদমিয়া, আলীখালি গ্রামের ব্যক্তিমালিকানাধীন ফসলি জমিতে এবং হোয়াইক্যং ইউনিয়নের পুটিবুনিয়া এলাকায় সরকারি খাসজমিতে রোহিঙ্গারা ঘর তুলে থাকছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় রোহিঙ্গাদের বসতির কারণে সবজি ও ধানের উৎপাদন আগের চেয়ে কমে গেছে। এতে স্থানীয় কৃষকেরা সমস্যার মুখে পড়েছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, স্থানীয়দের মালিকানাধীন ১০০ হেক্টর কৃষিজমিতে আর চাষাবাদ করা যাচ্ছে না। সেখানে রোহিঙ্গা বসবাস শুরু করেছে। অন্যদিকে কৃষিজমিতে সেচের পানি পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে সামগ্রিকভাবে কৃষিকাজ প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে। কক্সবাজারের প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংসের চিত্র তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, টেকনাফ ও উখিয়ার দুই হাজার হেক্টর বনভূমি ধ্বংস হয়ে গেছে। সেখান থেকে উজাড় হয়েছে ৭ লাখ ৫০ হাজার কেজির সমপরিমাণ কাঠ। স্থানীয় সব কটি পানির ছড়া দূষিত ও প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।

টেকনাফ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য বলছে, স্থানীয় বাসিন্দাদের একটি অংশ নাফ নদী থেকে মাছ ধরত। ২০১৭ সালের নভেম্বর থেকে নদীতে মাছ ধরা পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় যেসব জেলে নদীতে মাছ ধরতে, তারা বেকার হয়ে পড়েছেন।

স্থানীয় বাসিন্দাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা ‘রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির’ আহ্বায়ক মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা শুরুতে মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি। কিন্তু এখন তাদের কারণে আমাদের জীবন-জীবিকা, পরিবেশ ও প্রকৃতি সব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সরকারের উচিত দ্রুত তাদের নিজেদের দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা।’

অবশ্য প্রতিবেদনে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের খাদ্য পরিস্থিতির উন্নতি হলেও শুধু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কারণে কক্সবাজার জেলায় খাদ্যঝুঁকি তৈরি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ কারণে বিশ্বের খাদ্যঝুঁকিতে থাকা ৪৫টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নামও উঠে এসেছে।

এ বিষয়ে ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. শাহ কামাল গতকাল বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, কক্সবাজার এলাকার সামগ্রিক দারিদ্র্য পরিস্থিতির উন্নয়নের একটি পরিকল্পনা হচ্ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের শিবিরগুলো যে এলাকায় গড়ে উঠেছে সেটি ঘূর্ণিঝড়ের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে ৬ লাখ ২৮ হাজার রোহিঙ্গাই ঘূর্ণিঝড়ের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাস করছে।

রোহিঙ্গা শিবিরে কাজ করা দেশীয় এনজিওগুলোর জোটের সমন্বয়কারী ও কোস্টট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা এখন বাংলাদেশের জন্য উন্নয়ন ও নিরাপত্তা সমস্যায় রূপ নিয়েছে। রোহিঙ্গা শিবির এলাকার বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা যাচ্ছে না। অনেক স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে গেছে। ওই এলাকার পুরো প্রতিবেশব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে এখন বড় ধরনের বিপর্যয়ের জন্য অপেক্ষা করছে। ফলে পুরো কক্সবাজারকে রক্ষা করতে একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা করতে হবে।