সীমান্ত সংঘাত বাস্তবের সঙ্গে বেমানান

সীমান্তে বিএসএফ ও বিজিবির সংঘাত একান্তই অনভিপ্রেত। রয়টার্স ফাইল ছবি
সীমান্তে বিএসএফ ও বিজিবির সংঘাত একান্তই অনভিপ্রেত। রয়টার্স ফাইল ছবি

অল্প দিনের ব্যবধানে দুই গুরুত্বপূর্ণ নেতার তিন দেশ সফর নিয়ে ভাবনাচিন্তার মাঝে চেতনা আচ্ছন্ন হলো এমন এক ঘটনায়, যা শেষ কবে ঘটেছে চট করে মনে পড়া কঠিন। বাংলাদেশের রাজশাহী ও ভারতের মুর্শিদাবাদের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পদ্মায় ইলিশ ধরাকে কেন্দ্র করে ১৭ অক্টোবর বিএসএফ ও বিজিবির মধ্যে গুলিবিনিময়ে এক ভারতীয় হেড কনস্টেবলের মৃত্যু এবং আরেকজনের আহত হওয়া অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়ে গেল।

এর আগে ১০ অক্টোবর ভুল করে ভারতে প্রবেশের কারণে র‌্যাবের তিন সদস্যসহ পাঁচজন মারধরের শিকার হন বলে খবর প্রকাশিত হয়। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, দুই দেশের সম্পর্ককে কেন্দ্র করে, যা একরাশ বিস্ময় হয়ে ঝরছে! যে দুই দেশ একে অন্যকে ‘পরম বন্ধু ও বিশ্বস্ত’ মনে করে, যে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী নিয়মিত বৈঠক করে বকেয়া সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী হয়, তাদের মধ্যে কেন এমন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ? কেন প্রাণহানি? তবে কি ধরে নিতে হবে, সম্পর্কটা স্রেফ ওপর ওপর? ভেতরে অবিশ্বাস, ঘৃণা ও রেষারেষির ফল্গু? নাকি, এটা নিতান্তই বিচ্ছিন্ন এক ঘটনা?

সত্য হলো, কোনো বিবাদের মীমাংসায় বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে আলোচনা চলাকালে গুলি ও তাতে হতাহত হওয়ার মতো ঘটনা সাম্প্রতিক অতীতে ঘটেনি। সীমান্তে গুলির ঘটনা প্রায়ই ঘটে। রক্তপাত ও মৃত্যুও হয়। দুই দেশই সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তা সত্ত্বেও নিজেদের মধ্যে এমন ঘটনা ঘটল কেন? বিশেষত পদ্মাবক্ষে যখন দুই পক্ষই পাশাপাশি এবং দৃশ্যমান? তবে কি ধরে নিতে হবে, গত এক দশকে সম্পর্কের উন্নতির গগনচুম্বী উচ্চতার উচ্চকিত ঘোষণা অতিরঞ্জিত? ‘কসমেটিক’? বাস্তবের সঙ্গে বেমানান? প্রশ্নগুলো ভাবাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করে দেশে ফেরার পর থেকে সম্পাদিত সাত অনু চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের অন্তত তিনটি নিয়ে নিরন্তর আলোচনা চলছে। ফেনীর পানি দান, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে রান্নার গ্যাস রপ্তানি ও উপকূলে নজরদারিতে রাডার বসানো। সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা প্রবল। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকেও শুনতে হয়েছে এসব প্রশ্ন। তাঁর উত্তর যে সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি, প্রচারমাধ্যমে নিরন্তর আলোচনা তার প্রমাণ। প্রশ্ন উঠেছে, ‘মানবিক’ হাসিনা যদি ত্রিপুরাকে খাওয়ার পানি দিতে পারেন, ‘মানবিক’ ভারত কেন নয় বছরে তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন করে না? ভারতের চাহিদা ন্যায্য, বাংলাদেশেরটা অন্যায্য? দিল্লিতে হায়দরাবাদ হাউসে নরেন্দ্র মোদি ও শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে যে মুহূর্তে ফেনীর পানি দেওয়ার কথা ঘোষণা হলো, সফররত উপস্থিত বাংলাদেশি সাংবাদিকদের মধ্যে একটা চাপা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল! বলাবলি শুরু হলো, তিস্তা ও ফেনী চুক্তি একই সঙ্গে সম্পাদিত হওয়ার কথা ছিল! ফেনী নাও, তিস্তা দাও! অথচ তিস্তা অধরাই রইল! সেদিন থেকেই সামাজিক মাধ্যম নতুন করে মুখর, ‘ভারত শুধু নিতে জানে, দিতে নয়’!

বিএসএফ জওয়ান হত্যার ঘটনা কি তবে ওই অসন্তোষেরই এক আচমকা বহিঃপ্রকাশ? ক্রম পুঞ্জীভূত ভারতবিরোধিতার একটা স্ফুলিঙ্গ মাত্র? একদিকে দীর্ঘ অপ্রাপ্তির বেদনা, অন্যদিকে এনআরসি নিয়ে গরম-গরম কথা, বারংবার বিদেশিদের ‘উইপোকার’ সঙ্গে তুলনা, প্রতিবেশী তিন দেশের অমুসলমান নাগরিকদের আশ্রয়দানে আইন সংশোধনের বার্তা দুই দেশের মধ্যে একটা বিভাজনরেখা গভীরভাবে টেনে দিচ্ছে কি? নেতাদের এ কথা ভেবে দেখা দরকার। অন্ধ হলে প্রলয় কিন্তু বন্ধ থাকে না।

শেখ হাসিনার পিঠেপিঠিই ভারতে এলেন চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও চীনা প্রেসিডেন্ট দুজনই স্বীকার করেছেন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ‘নতুন সূচনা’ ঘটেছে। এই সফর দুই দেশকে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে আশ্বস্ত করেছে। ভারতের সবচেয়ে বড় লাভ সি-এর মুখ দিয়ে ‘কাশ্মীর’ শব্দটি উচ্চারিত না হওয়া। চীনের প্রাপ্তি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য রেষারেষি সত্ত্বেও ভারতের বাজার ধরে রেখে ভবিষ্যতের পথ প্রশস্ত করা।

সি-এর সফর চীন চূড়ান্ত করে মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগে। এই সফর শুরুর আগের দুই সপ্তাহ ভারতের কাছে যথেষ্ট টালমাটাল ছিল। কাশ্মীর প্রশ্নে জাতিসংঘের ভেতর-বাইরে চীনের অবস্থান ছিল পুরোপুরি পাকিস্তানের পাশে। ভারত সফরের চার দিন আগে পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের চীন যাত্রা ভারতকে চিন্তিত রেখেছিল। কাশ্মীর নিয়ে চীনের পরস্পরবিরোধী মন্তব্য সি-এর সফরের সাফল্য ঘিরে সংশয়ও সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যা হলো তা যেন ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’। প্রেসিডেন্ট সি কাশ্মীর প্রসঙ্গ তুললেন না। এই নিরুচ্চারিতা নিঃসন্দেহে ভারতের কূটনৈতিক সাফল্য। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক ঘাটতি দিনে দিনে স্ফীত হওয়ায় ভারতের অখুশির বহর বিস্তার লাভ করছিল। সেই বহর কমাতে চীনের রাজি হওয়াও ভারতের বড় পাওনা। দুই দেশই এই লক্ষ্যে ‘ইকোনমিক অ্যান্ড ট্রেড ডায়ালগ মেকানিজম’ গঠনে রাজি হয়েছে। ফার্মাসিউটিক্যাল ও তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে ভারতীয় লগ্নির জন্য চীন তার দরজা খুলে দিচ্ছে। ইউহানের পর মালাল্লাপুরমের ফুরফুরে আমেজের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট সি তৃতীয় অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে আসার জন্য মোদিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। মোদি তা গ্রহণও করেছেন।

সি-এর সফর ভারতের কাছে সাফল্যের বিজ্ঞাপন। পাল্টা প্রশ্ন উঠছে চীনের প্রাপ্তি নিয়ে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পরিধির বাইরে বের হয়ে প্রশ্নটি উপমহাদেশীয় নিরিখে দেখা প্রয়োজন। পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক অটুট। এটা সত্য। কাশ্মীর অনুচ্চারিত থাকলেও সি একবারের জন্যও বলেননি, কাশ্মীর প্রসঙ্গে ভারতের সব যুক্তি তাঁরা মেনে নিয়েছেন। সীমান্তসহ এই বিবাদও ঠান্ডা ঘরে রেখে বাণিজ্য বিস্তারে ভারতের বাজার ব্যবহারেই যে চীন বেশি আগ্রহী, তার প্রমাণ সি দিয়েছেন। তাঁর এই সফরের মধ্যেই ‘ইন্ডিয়া মোবাইল কংগ্রেস’ চীনা কোম্পানি হুয়াউইকে তার ক্ষমতা ও পরাক্রমের প্রমাণ দিতে ভারতে আমন্ত্রণ জানায়। ৫-জির ট্রায়ালে হুয়াউই যাতে ডাক পায় সেই চাপ এই সফরেও সি অব্যাহত রেখেছেন। সরকারিভাবে কোনো পক্ষই যদিও বিষয়টির অবতারণা করেনি। এটা যেমন সত্য, তেমনই এটাও ঠিক, ট্রায়ালে যে হুয়াউইকে ডাকা হবে না, সেই ঘোষণাও ভারত এখনো করেনি। মার্কিন চাপ মেনে ভারত শেষ পর্যন্ত বেঁকে বসবে কি না, এখনো তার ইঙ্গিত নেই। তেমন হলে সেটা হবে চীনের কাছে বেশ বড় একটা ধাক্কা। সেই ধাক্কার রেশ কোথায় গড়াতে পারে এখনো সেই আন্দাজ নেই।

প্রেসিডেন্ট সি-এর অতি প্রিয় ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই) প্রকল্পে ভারত সাড়া দেয়নি। ভারতকে রাজি করানোও সি-এর কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চাপ বাড়াতে তিনি বাংলাদেশ ও নেপালকে তাঁর মতো করে ব্যবহার করছেন। দুই দেশই বিআরআই প্রকল্পে অংশীদার। আপাতত সি-এর দৃষ্টি এই মাসের শেষে ব্যাংককে ‘অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস’-এর বৈঠকের দিকে। ওই বৈঠকে ১৬টি আঞ্চলিক দেশের মধ্যে সুসংহত অর্থনৈতিক অংশীদারত্বের জন্য মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল সৃষ্টি হওয়ার কথা। ভারত এখনো চীনা প্রভাবে আশঙ্কিত। কিন্তু ব্যাংকক সম্মেলনে যোগ দিলে সেটা অবশ্যই চীনের সাফল্য বলে মানতেই হবে।

সি এই প্রথম নেপাল গেলেন। টানা ২৩ বছর কোনো চীনা প্রেসিডেন্ট নেপাল যাননি। সি গিয়েই ২০টি চুক্তি সই করেছেন। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চীনের সঙ্গে নেপালের সংযুক্তিকারী ট্রান্স-হিমালয়ান করিডর তৈরি, যার অন্যতম প্রধান অঙ্গ তিব্বতের লাসা থেকে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু পর্যন্ত রেললাইন তৈরির প্রস্তাবনা। ভারতের জন্য এটা কিন্তু একটা স্পষ্ট বার্তা।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে প্রাধান্য পায় ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, বৈরিতা কারও সঙ্গে নয়’। কিন্তু নেপাল? ভারতের কাছ থেকে নেপালের দূরত্ব বেড়ে চলেছে। চীন ততই কাছে আসছে। নেপালও সদিচ্ছা দেখাচ্ছে। ভারতের স্বার্থেই তাই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কগুলোর নতুন মূল্যায়ন প্রয়োজন।

শেখ হাসিনার ভারত এবং সি চিন পিংয়ের ভারত ও নেপাল সফর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নতুন মেরুকরণের সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে। এ পরিস্থিতিতে বিএসএফ ও বিজিবির সংঘাত একান্তই অনভিপ্রেত। বাংলাদেশ নিজেকে চির উপেক্ষিত মনে করলে ভারতের পক্ষে তা মঙ্গলজনক হতে পারে না। দুই দেশেরই মনোযোগী হওয়ার এটা প্রকৃত ও উপযুক্ত সময়।