ঢাকায় স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় ব্যয় ৭০ কোটি টাকা, ফল শূন্য

অকেজো পড়ে আছে এসব সংকেত বাতি। সম্প্রতি গুলিস্তানে।  ছবি: হাসান রাজা
অকেজো পড়ে আছে এসব সংকেত বাতি। সম্প্রতি গুলিস্তানে। ছবি: হাসান রাজা

ঢাকা শহরে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য গত ১৯ বছরে নানা উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ ও সিটি করপোরেশন। এগুলো বাস্তবায়ন করতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭০ কোটি টাকা, কিন্তু কোনো কিছুই কাজে আসেনি। টিকে আছে পুলিশের হাতের ইশারা। এখনো ইশারাতেই নিয়ন্ত্রিত হয় ঢাকার প্রতিটি মোড়ের যানবাহন।

ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় যত প্রকল্প

ডিএসসিসির প্রকৌশল দপ্তর সূত্র জানায়, ২০০০ সালে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে (প্রায় ২৫ কোটি টাকা) ঢাকা শহরে গুরুত্বপূর্ণ ৭০টি মোড়ে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সংকেত বাতি বসানোর কাজ শুরু হয়। ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের আওতায় এই কাজ শেষ হয় ২০০৮ সালের দিকে। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবহার না হওয়ায় অল্প দিনেই অধিকাংশ বাতি অকেজো হয়ে পড়ে। ২০০৯ সালের নভেম্বরে নগরের অর্ধশতাধিক মোড়ে পরীক্ষামূলকভাবে স্বয়ংক্রিয় সংকেত বাতি ব্যবহার করে পুলিশ। তিন-চার দিনের মাথায় এই ব্যবস্থার পরিবর্তে পুলিশ সেই হাত ও বাঁশির ব্যবস্থায় ফিরে যায়।

২০১০-১১ অর্থবছরে ‘নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেইস)’ নামে আরেকটি প্রকল্প নেয় সিটি করপোরেশন। তখন প্রায় ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সংকেত সরঞ্জাম কেনা হয়। ২০১৫ সালে কাকলী থেকে শাহবাগ পর্যন্ত ১১টি পয়েন্টে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সংকেত ব্যবস্থা চালু করা হয়। কিন্তু চালুর পরেই তীব্র যানজটে পুরো ঢাকা স্থবির হয়ে পড়ে।

২০১২ সালে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা কার্যকর করতে ব্যর্থ হয়ে ‘আধা স্বয়ংক্রিয়’ ট্রাফিক সংকেত ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেয় কেইস প্রকল্প। এই প্রকল্পের অধীনে গত সাত বছরে নগরের বিভিন্ন স্থানে ৩২টি নতুন সংকেত বাতি বসানো হয়। তা নিয়ন্ত্রণ করা জন্য ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের হাতে দেওয়া হয়েছে রিমোট কন্ট্রোল। যে সড়কে যানবাহনের চাপ বেশি থাকবে, রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে পুলিশ সদস্যরা সেখানে সবুজ বাতি জ্বালাবেন, অন্য সড়কে তখন লাল বাতি জ্বলবে। কিন্তু বাস্তবে এই প্রকল্পও কোনো কাজে আসেনি। ডিএসসিসি সূত্র জানায়, এই ৩২টি সিগন্যাল বাতি স্থাপন ও বিদ্যমান বাতিগুলো রক্ষণাবেক্ষণে ৩২ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে।

সম্প্রতি রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ প্রায় ১৫টি সড়ক ঘুরে কোনোটিতেই সংকেত বাতি ব্যবস্থা কার্যকর দেখা যায়নি। হাতে লাঠি ও মুখে বাঁশি নিয়ে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছেন ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা।

নির্দেশনা বাস্তবায়িত হয়নি

২০১৮ সালের জুলাইয়ে ছাত্র আন্দোলনের পর ‘ঢাকা শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে’ সভা করেছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গভর্ন্যান্স ইনোভেশন ইউনিট। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয় বৈদ্যুতিক সংকেত বাতি এবং ট্রাফিক সংকেত নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগকে বুঝিয়ে দেওয়া কথা ছিল সিটি করপোরেশনের। কিন্তু এখনো সংকেত বাতিগুলো বুঝে নেয়নি পুলিশ।

পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের (দক্ষিণ) যুগ্ম কমিশনার আশরাফুজ্জামান বলেন, এখন নগরের অধিকাংশ সংকেত বাতি ঠিকমতো কাজ করে না। এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ট্রাফিক বিভাগে প্রকৌশলী নেই। তাই যথাসময়ে সিগন্যালগুলো বুঝে নেওয়া সম্ভব হয়নি।

>

নেওয়া হয়েছে বহু উদ্যোগ।
কিন্তু পুলিশের হাতের ইশারাতেই চলছে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা।

কেইস প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের সব সংকেত বাতি ঠিক আছে। তবে মেট্রোরেলের নির্মাণকাজের কারণে কিছু বাতি উঠিয়ে ফেলতে হয়েছে। তিনি বলেন, গত মার্চে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে। এর আগে সংকেত বাতিগুলো ট্রাফিক বিভাগকে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য বৈঠকও হয়েছে। কিন্তু তারা সংকেত নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের দায়িত্ব নেয়নি। এখন সংকেত ব্যবস্থা রক্ষণাবেক্ষণ করছে ডিএসসিসির বিদ্যুৎ বিভাগ ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ।

‘ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে’

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শামসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ হাতের ইশারায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করায় দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। চালক ও পথচারীদের মধ্যে বদ–অভ্যাস তৈরি হচ্ছে। এই বিষয়ে পুলিশকে আরও আন্তরিক হতে হবে। অন্যথায় আরও বড় প্রকল্প নিলেও ট্রাফিক খাতে সফলতা মিলবে না। তিনি আরও বলেন, এখন সংকেত বাতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের হাতে রিমোট রয়েছে। এটা যে কেউ চালাতে পারে। এর জন্য এখনই নতুন জনবল লাগবে, এটা ঠিক না। সংকেতগুলো সচল না রাখলে নষ্ট হয়ে যাবে। তখন পুলিশের হাতের ইশারা থেকে মুক্তি মিলবে না।