শামুকখোল পাখি নিয়ে বিপাকে আমচাষিরা

আমগাছের ডালজুড়ে পাখির বাসা। দিনভর কিচিরমিচির। পাখির ওড়াউড়ি। তবে বাচ্চা পাখিগুলো বাসার ভেতরেই চুপচাপ বসে। মাঝেমধ্যে একটু জোরে বাতাস এলেই কিছু বাসা উল্টে মাটিতে পড়ে যায়। নিচে তখন দাঁড়িয়ে থাকা শিশুদের দল সঙ্গে সঙ্গেই কুড়িয়ে নিয়ে ভোঁ-দৌড়। এই চিত্র রাজশাহীর বাঘা উপজেলার খোর্দ্দ বাউসা গ্রামের।

এই গ্রামের একটি বাগানের প্রায় ২৫টি আমগাছে শামুকখোল পাখিরা বাসা বেঁধেছে। চার বছর ধরে এই পাখি বর্ষার শেষে বাচ্চা জন্ম দিচ্ছে। শীতের আগে আগে আবার চলে যায়। মাঝের এই সময়টাতে পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে ওঠে বাগান ও আশপাশের পরিবেশ। এলাকার কিছু ডানপিটে শিশু-কিশোর মাঝেমধ্যে এসে আমগাছে ঝাঁকি দেয়। তখন বাসা থেকে বাচ্চা পাখি মাটিতে পড়ে। কুড়িয়ে নেয় শিশুরা। অনেকে সে পাখি নিয়ে আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি ঘুরতে যান। বাজারে বিক্রিও করেন কেউ কেউ।

এলাকার কিছু সচেতন ব্যক্তি এবং পাখিপ্রেমী অবশ্য শিশুদের পাখি শিকার থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করছেন। সংরক্ষণ করতে চাইছেন পাখিদের নিরাপদ আবাস। কিন্তু বাগানের চাষিরা বলছেন, গাছে পাখি বাসা বাঁধার পর থেকেই ওইসব গাছে আর আম ধরছে না। প্রতিবছর লোকসানে পড়তে হচ্ছে তাঁদের। তাঁদের দাবি, সরকারের পক্ষ থেকে পাখি সংরক্ষণের ব্যবস্থার পাশাপাশি আমচাষিদেরও সহায়তা করা হোক।

মূলত ২৫টি গাছে পাখি বাসা বাঁধে। সেখানে হাজারো পাখির বাসা। এই গাছগুলো পাঁচজন আমচাষির। ১১ অক্টোবর খোর্দ্দ বাউসা গ্রামে ঢুকতেই দেখা যায়, মাথার ওপরে দল বেঁধে পাখিরা উড়ছে। বাগানের কাছে যেতেই কানে ভেসে আসে পাখির কলকাকলি। এ যেন এক অন্য জগৎ। গাছের ডালে গাদাগাদি করে বসে আছে পাখি। দূরের গাছ থেকে ডাল ভেঙে নিয়ে আসছে। বাসা মেরামত করছে। বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছে। মা পাখির উঁচু সুর। আর বাচ্চা পাখির চিকন সুর।

আমবাগানের নিচে দল ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে স্থানীয় শিশুরা। বাগানের ভেতরে সাজ্জাদ নামের এক তরুণকে পাওয়া গেল। তিনি জানালেন, পাখি শিকার করে অনেকেই বাজারে বিক্রি করেন। প্রতি জোড়া পাখির দাম ২০০ টাকা। সাজ্জাদ নিজেও পাখি বিক্রি করেন। কত জোড়া বিক্রি করেছেন, সে হিসাব দিতে পারেননি তিনি।

গ্রামে পাখি আসতে দেখে চার বছর আগে প্রথমে বন অধিদপ্তরে খবর দিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম। এরপর বন অধিদপ্তর থেকে একটি সাইনবোর্ড দেওয়া হয়েছে বাগানের পাশে। রফিকুল বলেন, সাইনবোর্ডে বন্য প্রাণী হত্যার দায়ে সর্বোচ্চ ১২ বছরের শাস্তির কথা লেখা থাকলেও গ্রামের অনেক বাসিন্দা এর তোয়াক্কা করেন না। পাখি সংরক্ষণের জন্য বন অধিদপ্তরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

তবে এসব পাখি সংরক্ষণের জন্য নিজ উদ্যোগে কাজ করছেন স্থানীয় কিছু বাসিন্দা। তাঁরা বলছেন, সরকার কোনো প্রকল্পের মাধ্যমে যদি চাষিদের ক্ষতি পুষিয়ে দেয়, তাহলেই হয়তো আমগাছে পাখির বাসা রক্ষা পাবে। তা না হলে চাষিরাই একসময় ব্যবসার কথা ভেবে গাছ থেকে পাখিগুলোকে তাড়িয়ে দেবেন।

পাখির বাসা আছে, এমন সাতটি গাছের মালিক শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, একজন চাষির ৭০টি গাছের মধ্যে সাতটিতে পাখি থাকলে তা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু যে চাষির গাছই দুটি, তিনি কীভাবে মেনে নেবেন। তাই পাখি সংরক্ষণের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত আমচাষিদের সহায়তা করা দরকার। এতে পাখিগুলো রক্ষা পাবে। আমচাষিরাও উপকৃত হবেন।

বন অধিদপ্তর বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের প্রাণী পরিদর্শক জাহাঙ্গীর কবির বলেন, তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত আমচাষিদের তালিকা করেছেন। ক্ষতিগ্রস্তরা যাতে সহায়তা পান, সে জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করা হয়েছে।