ফুলে ফুলে ভরে গেল শিল্পীর কফিন

শহীদ মিনারে শিল্পী কালিদাস কর্মকারের মরদেহে ফুল দিচ্ছেন বিশিষ্টজনেরা। ছবি: প্রথম আলো
শহীদ মিনারে শিল্পী কালিদাস কর্মকারের মরদেহে ফুল দিচ্ছেন বিশিষ্টজনেরা। ছবি: প্রথম আলো

চারুকলার সবুজ ক্যাম্পাসে, শহীদ মিনারের সামনে তাঁকে অনেকবার দেখা গেছে। বারবার তিনি আসতেন। নানা আয়োজনে, প্রয়োজনে। মিশে যেতেন বন্ধু, অনুরাগীদের সঙ্গে। আজ সোমবার শেষবার তাঁর দেখা মিলল এসব জায়গায়। তিনি এসেছিলেন চারুকলা ক্যাম্পাসে, শহীদ মিনারে।

এদিন কফিনে মোড়া তাঁর নিথর দেহ। সচরাচর যেমন থাকতেন জীবনকালে—মাথায় তাঁর প্রিয় টুপি, গায়ে রঙিন জামা। ফুলে ছেয়ে গেছে শিল্পী কালিদাস কর্মকারের কফিন। আর কখনো তাঁকে দেখা যাবে না। আসবেন না কোনো আয়োজনে।

গত শুক্রবার দুপুরে চিত্রশিল্পী কালিদাস কর্মকারকে ঢাকার বাসা থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এরপর তাঁকে ল্যাবএইড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে চিকিৎসকেরা কালিদাসকে মৃত ঘোষণা করেন। দুই মেয়ের অপেক্ষায় ছিল তাঁর শেষযাত্রার আনুষ্ঠানিকতা। তাঁরা এসেছেন। সোমবার সকাল নয়টায় রাজধানীর বারডেম হাসপাতালের হিমঘর থেকে কালিদাস কর্মকারের মরদেহ নেওয়া হয় ঢাকেশ্বরী মন্দিরে। সেখান থেকে তাঁর শবযাত্রা যায় চারুকলা প্রাঙ্গণে। সেখান থেকে শহীদ মিনারে। শিল্পী, চারুশিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ফুলেল শ্রদ্ধা জানান বরেণ্য এ চিত্রশিল্পীকে। শহীদ মিনার থেকে কালিদাস কর্মকারের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয়েছে রাজধানীর সবুজবাগের বরদেশ্বরী কালীমন্দিরে। সেখানে বেলা সোয়া দুইটায় তাঁর দাহ শুরু হয়।

শিল্পী কালিদাস কর্মকার। সংগৃহীত
শিল্পী কালিদাস কর্মকার। সংগৃহীত

চারুকলা অনুষদ প্রাঙ্গণে প্রয়াত শিল্পী কালিদাস কর্মকারের প্রতি চারুকলা অনুষদের পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন। এ ছাড়া শ্রদ্ধা নিবেদন করেন চারুকলা অনুষদের অঙ্কন ও চিত্রায়ণ বিভাগ, ছাপচিত্র বিভাগ, ভাস্কর্য বিভাগ, কারুশিল্প বিভাগ, গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগ, প্রাচ্যকলা বিভাগ, মৃৎশিল্প বিভাগ এবং শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। আরও শ্রদ্ধা জানায় বিটিভি, গ্যালারি কসমস, ঢাবি ভাস্কর্য বিভাগ প্রাক্তনী সংঘ, ঢাকা আর্ট সার্কেল, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। ব্যক্তিগতভাবে কালিদাস কর্মকারের প্রতি শ্রদ্ধা জানান প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী, শিল্পী হাশেম খান, রফিকুন নবী, সৈয়দ আবুল বারক আলভী, কনকচাঁপা চাকমা, রোকেয়া সুলতানা প্রমুখ।

এরপর শহীদ মিনারে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদের ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত হয় নাগরিক শ্রদ্ধানুষ্ঠান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন তাঁর দুই মেয়ে কঙ্কা কর্মকার ও কেয়া কর্মকার। সাংগঠনিকভাবে শ্রদ্ধা জানায় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ, সম্প্রীতি বাংলাদেশ, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, গ্যালারি কসমস, ঢাকা গ্যালারি, বিসিক নকশাকেন্দ্র, শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘরসহ বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। ব্যক্তিগতভাবে কালিদাস কর্মকারের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসেন শিল্পী হামিদুজ্জামান খান, হাশেম খান, মনিরুল ইসলাম, শহীদ কাজী, রোকেয়া সুলতানা, ফরিদা জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আখতারুজ্জামান ও সহ-উপাচার্য মুহাম্মদ সামাদ, নাট্যজন লিয়াকত আলী লাকী, প্রাবন্ধিক মফিদুল হক প্রমুখ।

চারুকলা অনুষদে শেষশ্রদ্ধা। ছবি: সাইফুল ইসলাম
চারুকলা অনুষদে শেষশ্রদ্ধা। ছবি: সাইফুল ইসলাম

শ্রদ্ধা জানিয়ে শিল্পীকে নিয়ে নিজেদের অনুভূতি জানান বিশিষ্টজনেরা। গওহর রিজভী মন্তব্য করেন, ‘আমরা শুধু একজন শিল্পীকে নয়, পরম বন্ধুকে হারিয়েছি।’ শিল্পী রফিকুন নবী বলেন, ‘তার চলে যাওয়াটা আকস্মিক। আমি তার শিক্ষক ছিলাম। চারুকলায় বেশ কয়েক বছর আমি তাকে দেখেছি। সব সময় একধরনের কর্মব্যস্ততা তাকে তাড়িয়ে বেরাত। এত এত মাধ্যমে কাজ করেছে যে, মাঝে মাঝে নিজের কাছেই বিস্ময় মনে হতো। তার চলে যাওয়াটা শিল্পকলার জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।’ হাশেম খান বলেন, ‘কালিদাস কর্মকার বাংলাদেশের শিল্পকে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত করার জন্য নিরলস কাজ করেছেন।’ নিসার হোসেন বলেন, কালিদাস কর্মকার বহু ধরনের কাজ করতেন। সেটিকে একটি ভিন্নমাত্রা দিতেন। নিজে যেমন চিত্রকর্মের ফর্ম গড়েছেন, ঠিক তেমনিভাবে সেটিকে ভেঙে আবার নতুন কিছু করেছেন। শিল্পমাধ্যমের এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে তিনি কাজ করেননি।

মেয়ে কঙ্কা কর্মকার জানালেন, এখন থেকে প্রতিবছর বাবার নামে প্রদর্শনী করবেন তাঁরা। কঙ্কা মনে করেন, শিল্পীর সৃজনশীল কাজের কারণে মানুষ তাঁকে মনে রাখবে। এ সময় বাবার অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার জন্য তিনি সবার সহযোগিতা চান।

শহীদ মিনারে এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় এ শ্রদ্ধানুষ্ঠান। তারপর তাঁর শবযাত্রা শহীদ মিনার থেকে রাজধানীর সবুজবাগের বরদেশ্বরী কালীমন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়।

ফুলে ফুলে ভরে গেল কফিন। ছবি: সাইফুল ইসলাম
ফুলে ফুলে ভরে গেল কফিন। ছবি: সাইফুল ইসলাম

কালিদাস কর্মকার ১৯৪৬ সালে ফরিদপুর শহরের জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬২-৬৪ এই তিন বছর তৎকালীন ঢাকা আর্ট ইনস্টিটিউট থেকে সূচনা কোর্স শেষ করে ১৯৬৯ সালে কলকাতায় সরকারি আর্ট কলেজ থেকে চারুকলায় স্নাতক করেন। এ ছাড়া ভারত, পোল্যান্ড, ফ্রান্স, জাপান, কোরিয়া, আমেরিকায় আধুনিক শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমে উচ্চতর ফেলোশিপ নিয়ে সমকালীন চারুকলার নানা মাধ্যমে তিনি প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আসছিলেন। ১৯৭৬ সাল থেকে ফ্রিল্যান্স শিল্পী হিসেবে দেশে-বিদেশে কাজ করে আসছিলেন তিনি। শিল্পকর্মে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন পলিমাটির মানুষের সংগ্রাম। ভালো আলোকচিত্রীও ছিলেন তিনি। দেশে-বিদেশে তাঁর ৭১টি চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাঁর একক চিত্রপ্রদর্শনীর সংখ্যা চারুশিল্পীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া তিনি বহু আন্তর্জাতিক দলবদ্ধ প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন। জীবদ্দশায় একুশে পদক, শিল্পকলা পদক, এস এম সুলতান পদকসহ দেশ–বিদেশে অসংখ্য স্বীকৃতি পেয়েছেন বরেণ্য এই চিত্রশিল্পী।
বিপত্নীক কালিদাস কর্মকার বেশির ভাগ সময় যুক্তরাষ্ট্রে থাকতেন। সর্বশেষ ২ অক্টোবর তিনি দেশে ফেরেন।