রনবীর বাসায় রহস্যময় চোর

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

চোরের উৎপাত ঠেকাতে নিজের বাসার বিভিন্ন স্থানে আটটি সিসি ক্যামেরা বসিয়েছিলেন খ্যাতনামা চিত্রকর ও কার্টুনিস্ট রফিকুন নবী। বাড়ির এক পাশের সীমানাও উঁচু করেন। আঙিনা আলোকিত করে রাখার জন্য ফ্লাড লাইটের ব্যবস্থা করার পরও শেষরক্ষা হয়নি। চোর তাঁর বাসায় হানা দিয়েই চলেছে। গত এক মাসে তিনবার বাসায় চোর ঢুকেছে। গতকাল সোমবার দুপুরেও চার চোর এসেছিল। তারা বাসার নিচতলার কক্ষের সবকিছু তছনছ করে চলে যায়।

‘টোকাই’ চরিত্র সৃষ্টি করে রনবী নামে জনপ্রিয়তা পাওয়া রফিকুন নবীর বাসা রাজধানীর মিরপুরের দক্ষিণ মণিপুরে। চারতলা এই বাড়িতে ২৯ বছর ধরে তিনি পরিবার নিয়ে থাকছেন। এত বছর কোনো সমস্যা না হলেও ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে চোর তাঁর বাসায় উৎপাত করছে।

রফিকুন নবী বললেন, পুলিশের পরামর্শেই তিনি বাসায় নিরাপত্তাব্যবস্থা বাড়িয়েছিলেন। অভিযোগ জানার পর থানা–পুলিশ সকাল–দুপুর–বিকেল নিয়ম করে তাঁর বাসায় এসেছে। খোঁজখবর নিয়ে চলে গেছে। কিন্তু চোরের উৎপাত কমেনি। বাড়ির এক পাশের সীমানাপ্রাচীর উঁচু করার পর থেকে চোরেরা প্রতি রাতে নিয়ম করে ঢিল মারছে তাঁর গাড়ির গ্যারেজের টিনে। তবে বাসা ঘিরে চোরের এত তৎপরতা থাকলেও পুলিশ কাউকেই ধরতে পারেনি।

বাংলাদেশের অগ্রগণ্য শিল্পী রফিকুন নবী ২০০৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন হিসেবে অবসর নেন। প্রায় ৪৬ বছর তিনি সেখানে শিক্ষকতা করেন। তরুণ বয়স থেকেই লেখালেখির সঙ্গে তিনি যুক্ত। সাহিত্যের প্রায় সব ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণ রয়েছে। ছোটদের ছড়া, কবিতা, কিশোর উপন্যাস, গল্প-উপন্যাস ও ভ্রমণকাহিনি লিখেছেন তিনি। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

গতকাল সন্ধ্যায় তাঁর বাসায় গেলে রফিকুন নবী প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৭ সালে চোর যখন প্রথম হানা দেয়, তখন তাঁর একুশে পদকের সোনার মেডেল, নগদ টাকাপয়সা ও গয়না নিয়ে যায়। এর দুই বছর পর সেই সেপ্টেম্বর মাস থেকেই তারা আবার হানা দিতে শুরু করেছে। গতকাল পর্যন্ত এক মাসে তিনবার এলেও এখন পর্যন্ত তাঁর উল্লেখযোগ্য কিছু খোয়া যায়নি।

রফিকুন নবী বলেন, গত ১৭ সেপ্টেম্বর তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জে তাঁর গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন। বাড়িতে স্ত্রী, ছোট ছেলে আর কাজের ছেলেমেয়েরা ছিল। সেদিন রাতে চোর বাসার চতুর্থ তলায় ঢোকে। তারা তাঁর আঁকার জিনিসপত্র, রং সবকিছু তছনছ করে চলে যায়। কিছু নিয়ে যায়নি। কিছু খোয়া না যাওয়ায় পরিবারের পক্ষ থেকে সেদিন তাঁকে কিছু জানানো হয়নি। এর এক দিন পর ১৯ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে আবারও চোর আসে। চোরের দল তৃতীয় তলায় হানা দেয়। সেখানে একটি কক্ষে তাঁর কাজের ছেলে থাকায় চোরেরা তাকে মারধর করে, গলায় ছুরি ধরে শাসায়। কিন্তু সেদিনও তারা বাসা থেকে কিছু নেয়নি।

সর্বশেষ গতকাল সোমবার বেলা সোয়া তিনটার দিকে চার চোর হানা দেয় রফিকুন নবীর বাসায়। এ সময় তিনি ও তাঁর স্ত্রী বাসার বাইরে ছিলেন। ঘরে ছিল কাজের ছেলে মিম। মিম ঘটনার বর্ণনা দিয়ে প্রথম আলোকে বলে, প্রথমে মুখোশ পরা এক ব্যক্তি বাসায় ঢোকে। তাকে দেখে মুখে কাপড় গুঁজে দেয়। এরপর সিসি ক্যামেরার সংযোগ বন্ধ করে দেয়। মুঠোফোনে কাউকে ফোন করে ভেতরে ঢুকতে বলে। তখন আরও তিনজন বাসায় ঢোকে। চারজনের মধ্যে তিনজনের পরনে ছিল কালো শার্ট এবং সাদা প্যান্ট ও জুতা। এই তিনজনের হাতে কালো হাতমোজা এবং মুখে কালো মুখোশ পরা ছিল। আর অন্যজন ছিল সাদা লুঙ্গি ও সবুজ গেঞ্জি পরা। তার মুখ বাঁধা ছিল গামছা দিয়ে।

মিমের ভাষ্যমতে, এই ব্যক্তি ছিলেন চাবির কারিগর। তাঁর কাঁধে কাঠের একটি বাক্স ছিল। আর হাতে ছিল চাবির ঝুটা। চারজনের মধ্যে দুজন মিমকে নিয়ে বৈঠকখানায় বসে। বাকি দুজন নিচতলায় রফিকুন নবী ও তাঁর স্ত্রীর থাকার ঘরের তালা খুলে ভেতরে ঢোকে। জিনিসপত্র তছনছ করে চলে যায়।

রফিকুন নবী জানান, চোরেরা আলমারির তালাও খুলেছে। তারা কিছু নিয়ে যায়নি। কিন্তু খামের মতো যত কিছু পেয়েছে, সবকিছু খুলেছে।

রফিকুন নবীর গাড়িচালক রবিউল ইসলাম মনে করছেন, ২০১৭ সালে যারা চুরি করতে এসেছিল, তারাই এবারও বারবার হানা দিচ্ছে। যুক্তি হিসেবে তিনি বলছেন, ১৯ সেপ্টেম্বর চোরেরা যখন তৃতীয় তলায় হানা দিয়েছিল, তখন কাজের ছেলে মিমকে তারা বলেছিল, দুই বছর আগেও তারা এই বাসায় এসেছিল এবং অনেক কিছু পেয়েছে। এবার কোনো কিছু পাচ্ছে না। এ ছাড়া গ্যারেজের চালায় ঢিল ছোড়ার পর কয়েক দিন তিনি ও মিম মিলে পাহারা দিয়েছিলেন। তখনো দেখেছেন তিনজন ব্যক্তি মুখোশ পরে কাজটি করছে। একদিন তাঁরা ধাওয়া দিয়েও নাগাল পাননি।

মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুস্তাজিলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনা জেনে তিনি নিজেও রফিকুন নবীর বাসায় গিয়েছিলেন। বিষয়টি তাঁরা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন।