শ্বাসতন্ত্রের রোগে ভুগছে রোহিঙ্গারা

রোহিঙ্গা শিবিরে চলছে তীব্র পানিসংকট। দূরদূরান্ত থেকে জারিকেন ও কলসিতে পানি সংগ্রহ করে ঘরে ফিরছে শিশুরা। গতকাল দুপুরে কক্সবাজারের টেকনাফের জাদিমোরা শালবাগান শিবিরে।  ছবি: গিয়াস উদ্দিন
রোহিঙ্গা শিবিরে চলছে তীব্র পানিসংকট। দূরদূরান্ত থেকে জারিকেন ও কলসিতে পানি সংগ্রহ করে ঘরে ফিরছে শিশুরা। গতকাল দুপুরে কক্সবাজারের টেকনাফের জাদিমোরা শালবাগান শিবিরে। ছবি: গিয়াস উদ্দিন

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে সংক্রামক রোগ খুব বেশি। অপুষ্টি, ঘনবসতি, দুর্বল পয়োব্যবস্থা, নিরাপদ পানির সংকট ও অপর্যাপ্ত টিকার কারণে রোহিঙ্গারা সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

গত শনিবার চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেট-এ প্রকাশিত রোহিঙ্গা শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকিবিষয়ক এক নিবন্ধে এ চিত্র উঠে এসেছে। তাতে বলা হয়, ২০১৭ সালের নভেম্বরে রোহিঙ্গা শিবিরে ডিফথেরিয়ার প্রকোপটি ছিল বিশ্বের বৃহত্তম ডিফথেরিয়া প্রকোপগুলোর একটি। ডিফথেরিয়ার এই প্রকোপ ২০১৮ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

এ ছাড়া পানীয় জলের সংকট বেড়ে যাওয়ায় রোহিঙ্গা শিবিরে ডায়রিয়ার প্রকোপও দেখা দিয়েছে। অন্তত একটি শিবিরে কলেরার রোগী পাওয়া গেছে বলে জেলা সিভিল সার্জন প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন।

ল্যানসেট বলছে, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের বিষয়। বর্তমানে ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। এদের ৫৫ শতাংশই শিশু। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে বছরের পর বছর গণহত্যা, জাতিগত নিপীড়ন ও বৈষম্যের শিকার হয়েছে। নিরাপত্তা ও নাগরিকত্বের নিশ্চয়তার দাবি জানিয়ে সম্প্রতি তারা নিজেদের দেশে ফেরত যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গা শিশুরা ভালো নেই, দীর্ঘদিন বাংলাদেশে অবস্থান করলে ভবিষ্যৎও বিপন্ন হবে। ল্যানসেট-এর নিবন্ধে ২০১৮ ও ২০১৯ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পূর্বসতর্ক, হুঁশিয়ারি ও সাড়াদান পদ্ধতির উপাত্তের তুলনা তুলে ধরা হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, রোহিঙ্গাদের মধ্যে তীব্র শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ বাড়ছে। আবার জখমের হারও এক বছরে বেড়েছে।

রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলার সিভিল সার্জন মো. আবদুল মতিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘অল্প একটু জায়গায় বহু মানুষ থাকে। মারামারি করে কিছু মানুষ আহত হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।’

ল্যানসেট বলছে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর চেষ্টায় রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যের কিছু ক্ষেত্রে উন্নতি দেখা যাচ্ছে। তীব্র অপুষ্টির হার ১৯ থেকে কমে ১২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে টিকা পাওয়ার হার ছিল ৩ শতাংশের কম। এখন তা বেড়ে ৮৯ শতাংশ হয়েছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সন্তান প্রসবের হার ২২ থেকে বেড়ে ৪০ শতাংশ হয়েছে।

তবে পুষ্টি পরিস্থিতি খুবই নাজুক। ৬-২৩ মাস বয়সী ৫০ শতাংশ শিশু রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। ০-৫৯ মাস বয়সী শিশুদের মধ্যে খর্বতা বড় উদ্বেগের বিষয়। এসব শিশুর বয়সের তুলনায় উচ্চতা কম।

ল্যানসেট-এর নিবন্ধে শিক্ষা পরিস্থিতিরও কিছু তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রাক্-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাবঞ্চিত হচ্ছে ওই বয়সী ৫০ শতাংশ শিশু। মাত্র ৩ শতাংশ রোহিঙ্গা কিশোর-কিশোরী শিক্ষা ও জীবনদক্ষতা প্রশিক্ষণের সুযোগ পাচ্ছে। ৫২ শতাংশ শিশু আবেগজনিত সমস্যায় (উদ্বেগ, বিষণ্নতা, মানিয়ে নিতে না পারার জটিলতা) ভুগছে।

কলেরা দেখা দিয়েছে

নিবন্ধে ৩ ধরনের ডায়রিয়ায় রোহিঙ্গারা আক্রান্ত হচ্ছে বলে দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে টেকনাফ উপজেলার জাজিমুড়ার ২৬ নম্বর শিবিরে ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিয়েছে বলে স্থানীয় একাধিক সূত্র প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছে। জেলা সিভিল মো. আবদুল মতিন বলেছেন, এই শিবিরে ৬৭ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক কলেরায় আক্রান্ত ছিল।

কলেরার ঝুঁকি শুরু থেকেই ছিল। এ জন্য রোহিঙ্গাদের টিকাও দেওয়া হয়েছিল। নতুন করে টিকা দেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে।

সিভিল সার্জন মো. আবদুল মতিন বলেন, শিবিরগুলোতে নিরাপদ পানীয় জলের খুব সংকট। যে পুকুর থেকে পানি নিয়ে গোসল ও ধোয়াপালার কাজ করা হয়, সেই পানিও যথেষ্ট পরিষ্কার নয়। তবে পানীয় জলের সংকট দূর করার চেষ্টা চলছে।