মেডিকেলে পড়া নিয়ে সংশয়

অভাবের সংসার ওঁদের। অনেক অপ্রাপ্তিতেও ভাঙেনি মনোবল। বরং ভালো কিছু করার তাড়না ছিল ভেতরে। ভর্তি পরীক্ষায় ভালো ফল করে ওঁরা চারজনই দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু এই অর্জনে তাঁদের মনে জমেছে শঙ্কার কালো মেঘ। চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন বুঝি ভেস্তে যায়! মেডিকেলে ভর্তি এবং পরের কয়েক বছর পড়ার খরচ জোগানোই এখন তাঁদের মূল চিন্তা। 

ছন্দা রানী
ছন্দা রানী

ভর্তি আটকে আছে ছন্দার
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন গাইবান্ধার ছন্দা রানী। কিন্তু তাঁর স্বপ্নযাত্রা থেমে যেতে বসেছে। মেডিকেলে ভর্তির টাকা জোগাড়ে হিমশিম খাচ্ছে তাঁর পরিবার। শেষ পর্যন্ত ভর্তি হতে পারবেন কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছেন।

ছন্দার বাড়ি গাইবান্ধা সদর উপজেলার বল্লমঝাড় ইউনিয়নের নারায়ণপুর গ্রামে। বাবা প্রদ্বত কুমার সরকার মুদিদোকানি। মা জোসনা রানী সরকার গৃহিণী। তিন ভাই–বোনের মধ্যে ছন্দা বড়। ছোট বোন জয়া রানী গাইবান্ধা সরকারি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়ে। ছোট ভাই মিতুল সরকার অষ্টম শ্রেণির ছাত্র।

ছন্দা পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছিলেন জেলার অন্যতম বিদ্যাপীঠ আহম্মেদ উদ্দিন শাহ শিশু নিকেতন স্কুল ও কলেজ থেকে। অষ্টম শ্রেণিতেও বৃত্তি পেয়েছিলেন। এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছেন। ২০১৯ সালে গাইবান্ধা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ তাঁর।

প্রদ্বত কুমার সরকার জানান, মুদিদোকান থেকে যা আয়, তা সংসারের ভরণপোষণে চলে যায়। সম্পত্তি বলতে ছিল কেবল বসতভিটা। দুই বছর আগে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে তা–ও বিক্রি করেছেন। এখন ভাড়া বাসায় থাকেন। তিনি বলেন, ‘২১ অক্টোবর থেকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি শুরু হয়েছে। শেষ তারিখ ৩১ অক্টোবর। ভর্তি হতে কমপক্ষে ২৫ হাজার টাকার দরকার, যা সংগ্রহ করা আমার পক্ষে এখন অসম্ভব।’ ছন্দার মা জোসনা রানী সরকার বলেন, ‘আগে বাসায় লেখাপড়া করেছে, টাকাপয়সা তেমন লাগেনি। কষ্ট করে খরচ জুগিয়েছি। এখন ছন্দা মেডিকেলে পড়বে। ভর্তি হতে অনেক টাকার দরকার। প্রতি মাসেও টাকা দিতে হবে। এখন ভর্তির টাকা দেব কোত্থেকে। আর মাসে মাসে টাকাই–বা কীভাবে দেব।’

ছন্দা বলেন, ‘চিকিৎসক হয়ে মা–বাবার দুঃখ ঘোচাতে চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম বিনা মূল্যে গরিব মানুষের চিকিৎসাসেবা দিতে। কিন্তু টাকার অভাবে আমার সেই স্বপ্ন পূরণ হবে কি না জানি না।’

সবুজ হোসেন
সবুজ হোসেন

অনিশ্চয়তায় বগুড়ার সবুজ
বগুড়ার ধুনট উপজেলার ভ্যানচালক বেলাল হোসেনের ছেলে সবুজ হোসেন। নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে তিনিও সুযোগ পেয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার। কিন্তু অর্থের অভাবে রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে তাঁর ইচ্ছেপূরণের পথ।

সবুজের বাড়ি বগুড়ার ধুনট পৌর এলাকার জিঞ্জিরতলা গ্রামে। মা ফুলেরা বেগম গৃহিণী। পাঁচজনের পরিবার। জরাজীর্ণ একটি বাড়িতে বসবাস। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি বেলাল। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবুজ দ্বিতীয়। তিনি ছোটবেলা থেকেই মেধাবী। জেএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছেন। ২০১৭ সালে একই বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পান এবং ২০১৯ সালে নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পেয়েছেন জিপিএ-৫। ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু সন্তানের ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড়ে নেমে কূলকিনারা পাচ্ছেন না বেলাল।

সবুজ বলেন, ছোটবেলায় এলাকার বড় ভাইদের মুখে মেডিকেল কলেজের গল্প শুনে সেখানে ভর্তির বাসনা তৈরি হয়েছে। নিত্য অভাবের সংসারে পথচলা কখনোই মসৃণ ছিল না। ভবিষ্যতে দেশ এবং এলাকার মানুষের পাশে থেকে সেবা করতে চান। কিন্তু টাকার অভাবে সেই স্বপ্ন থমকে যেতে বসেছে।

তানিয়া খাতুন
তানিয়া খাতুন

দুশ্চিন্তায় পটুয়াখালীর তানিয়া
দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান তানিয়া খাতুন পটুয়াখালী সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। তিনি নাটোরের বাগাতিপাড়ার সদর ইউনিয়নের কোয়ালীপাড়া গ্রামের আবু তালেবের মেয়ে। মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পেয়ে পরিবারে আনন্দের তুলনায় দুশ্চিন্তা বেশি।

সামান্য জমিতে আবাদ করে কোনোমতে সংসার চালান তাঁর বাবা আবু তালেব। স্বল্প আয়েই সন্তানদের পড়ালেখার খরচ চালান তিনি। দুই মেয়ে তানিয়া ও তিশা পড়াশোনায় ভালো ছোটবেলা থেকেই। তাই টানাপোড়েনের মধ্যেও মেয়েদের লেখাপড়ায় বিশেষ মনোযোগী ছিলেন। এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া তানিয়া পটুয়াখালী মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। আরেক মেয়ে তিশা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য চেষ্টা করছেন। অজপাড়াগাঁ থেকে তানিয়ার এমন সাফল্যে গ্রামবাসীও খুশি। কিন্তু এত দিন খরচ চালিয়ে এলেও কৃষক আবু তালেব দুই মেয়ের আগামী দিনের খরচগুলো কীভাবে চালাবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। তানিয়ার ভর্তির টাকা জোগাড় করতে আয়ের সম্বল সামান্য জমিও ইজারা দিয়েছেন। কিন্তু তাতেও পুরোপুরি টাকা জোগাড় হয়নি। 

তানিয়া বলেন, তাঁর এ সাফল্যে তিনি মা-বাবা এবং মামা আবদুস সালামের পর স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের প্রতি কৃতজ্ঞ। মেডিকেলে ভর্তি হয়ে ভালো চিকিৎসক হয়ে দরিদ্র মা-বাবার মুখ তিনি উজ্জ্বল করতে চান। 

জাকিয়া সুলতানা
জাকিয়া সুলতানা

আনন্দ নেই জাকিয়ার মনে
বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন নীলফামারীর সৈয়দপুর শহরের কয়ানিজপাড়া মহল্লার রাজমিস্ত্রি জাকারিয়ার মেয়ে জাকিয়া সুলতানা। তাঁর কৃতিত্বের খবরে আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব—সবার মনে আনন্দ। কিন্তু জাকিয়ার মনে দুশ্চিন্তার কালো মেঘ।

বাবা রাজমিস্ত্রির কাজ করে কোনোরকমে সংসার চালালেও সন্তানদের লেখাপড়ার ক্ষেত্রে ছিলেন খুবই মনোযোগী। শত কষ্টের মধ্যেও তিনি সন্তানদের শিক্ষা কার্যক্রমে কোনো রকম ব্যাঘাত ঘটতে দেননি। বাবার এ রকম মানসিকতা আর মায়ের যত্নে সন্তানেরাও লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয় প্রতিটি ক্লাসে। বড় মেয়ে জয়নাব আরা ঢাকা নার্সিং কলেজে পড়ছে। দ্বিতীয় জাকিয়া সুলতানা সৈয়দপুর সরকারি কারিগরি মহাবিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং এবার মেডিকেলেও সুযোগ পেলেন।

(প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন গাইবান্ধা, নাটোর, বগুড়ার ধুনট এবং নীলফামারীর সৈয়দপুর প্রতিনিধি)