ইউরোপে বাজারসুবিধা: সুশাসন ও মানবাধিকারে উন্নতির তাগিদ ইইউর

ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)।

ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা অব্যাহত রাখতে হলে গণতন্ত্র, সুশাসন, শ্রম অধিকার, মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলোতে বাংলাদেশকে আরও উন্নতি করতে হবে। এ বিষয়গুলোতে উন্নতির জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পাশাপাশি জোটের সদস্য ২৭টি দেশের সঙ্গেও বাংলাদেশকে আগামী দুই বছরে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে।

ইইউ বাংলাদেশকে বলেছে, ইবিএ বা এভরিথিং বাট আর্মসের (অস্ত্র ছাড়া সবকিছু) আওতায় স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্যসুবিধায় পরিবর্তন আসছে। নতুন ওই বাণিজ্যব্যবস্থায় সুশাসন ও মানবাধিকারের বিষয়গুলোতে আরও কঠোর অবস্থান নেওয়ার কথা ভাবছে ইইউ। ফলে ইউরোপের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্কের ভিত্তিমূল হবে মানবাধিকার। তবে অর্থনীতিতে অব্যাহতভাবে ভালো করতে থাকা বাংলাদেশের মতো দেশগুলো যাতে বিশেষ সুবিধা পায়, সে বিষয়টিকেও ইইউ বিবেচনায় নিচ্ছে।

গত সোমবার ঢাকায় ইইউ কর্মকর্তারা বাংলাদেশের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেন। এই বৈঠকে শ্রম ও মানবাধিকারের বেশ কিছু বিষয়ে উন্নতির জন্য দুই পক্ষ একটি রোডম্যাপ (পথনকশা) করতে একমত হয়। তবে ওই পথনকশায় ইইউ একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা যুক্ত করতে চাইলেও বাংলাদেশ তাতে রাজি হয়নি। ইইউ বলেছে, বাংলাদেশ সরকার, মালিক ও শ্রমিকদের ত্রিপক্ষীয় অংশগ্রহণ এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কারিগরি সহযোগিতায় আগামী এক বছরের মধ্যে শ্রম অধিকারের অন্তত নয়টি বিষয়ে বাংলাদেশকে উন্নতি করতে হবে। এ বিষয়গুলোর মধ্যে আছে রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা (ইপিজেডগুলো) এবং এর বাইরে অভিন্ন শ্রম আইন বাস্তবায়ন করা। ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম পুরোপুরি বিলোপে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা, শ্রমিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, নির্যাতন, হয়রানি বন্ধসহ ইউনিয়নবিরোধী কার্যক্রম বন্ধ করা। আইন, পররাষ্ট্র ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশ-ইইউর বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে তাঁর দপ্তরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইউরোপের দেশগুলো এবং ইইউর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের বিষয়টিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জোর দিচ্ছেন। এ জন্য সম্পর্ককে পরবর্তী ধাপে নিতে ইইউর সঙ্গে আমরা বিভিন্ন বিষয়ে ইতিবাচকভাবে কাজ করতে চাই।’

বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ইইউকে বলা হয়েছে, শ্রম পরিস্থিতির উন্নয়নে বাংলাদেশ শ্রম আইনে এ পর্যন্ত পাঁচবার সংশোধনী এনেছে। প্রয়োজনে আবার সংশোধন আনবে। রাতারাতি পুরো পরিস্থিতি পাল্টানো সম্ভব নয়। তবে পরিস্থিতি অনুযায়ী পরিবর্তন আনতে বাংলাদেশ উদ্যোগ নেবে। তবে সময় বেঁধে দিয়ে পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন সম্ভব নয় বলে মনে করে বাংলাদেশ।

পররাষ্ট্র ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে জানান, আলোচনার একপর্যায়ে ইইউ প্রতিনিধিদল বাংলাদেশকে সুশাসন ও মানবাধিকারের মানদণ্ডের উন্নতিতে সহায়তা করার আগ্রহ দেখায়। বিশেষ করে বাংলাদেশ এ বিষয়গুলোয় কীভাবে কাজ করবে, জানতে চাইলে ইইউর পক্ষ থেকে বলা হয়, আগামী ১৮ থেকে ২৪ মাসের মধ্যে এ বিষয়গুলো নিয়ে ব্রাসেলসে ইইউ সদর দপ্তরের পাশাপাশি সব দেশের সঙ্গে আলাদা করে আলোচনা করে সমাধানের চেষ্টা চালাতে হবে। পাশাপাশি এ বিষয়গুলোয় উন্নতির চেষ্টা যে বাংলাদেশের আছে, সে ব্যাপারে ইউরোপে ইতিবাচক বার্তা পাঠাতে হবে।

বৈঠকের পর ইইউর বহিঃসম্পর্ক বিভাগের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক পাওলা প্যাম্পালোনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ মানবাধিকারের কিছু বিষয়ে আমরা উদ্বেগ তুলে ধরেছি। এসব উদ্বেগ কীভাবে দূর করা যায়, তা নিয়ে আলোচনার জন্য দুই পক্ষ একমত হয়েছে।’

দুই পক্ষের বৈঠক শেষে প্রচারিত যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, উভয় পক্ষই স্বীকার করে যে ইইউর ইবিএর আওতায় বাংলাদেশ যে অগ্রাধিকারমূলক বাজার–সুবিধা (জিএসপি) পাচ্ছে, তা এ দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ২০০৬ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে ইইউর সদস্যদেশগুলোয় রপ্তানি তিন গুণেরও বেশি বেড়েছে। ইবিএর আওতায় ইইউভুক্ত দেশগুলোয় প্রবেশ করা পণ্যের ৬২ শতাংশই বাংলাদেশের। সে অনুযায়ী ইবিএর সবচেয়ে সুফলভোগী হচ্ছে বাংলাদেশ। দুই পক্ষ বাংলাদেশে ইইউর বাণিজ্য ও বিনিয়োগে বাধাগুলো দূর করতে ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নতির জন্য নিয়মিত আলোচনার প্রক্রিয়া জোরদারের জন্য অঙ্গীকার করেছে।

বাংলাদেশ থেকে ইইউভুক্ত দেশগুলোয় রপ্তানি করা পণ্যের মধ্যে রয়েছে তৈরি পোশাক, হোম টেক্সটাইল, চামড়ার জুতা, বাইসাইকেল, হিমায়িত চিংড়ি ও পাটজাত পণ্য।

ইইউর সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেওয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তৈরি পোশাক কারখানার পরিবেশের উন্নতিতে বাংলাদেশের নেওয়া পদক্ষেপের উন্নতির প্রশংসা করেছে। শ্রম অধিকারের বেশ কিছু ক্ষেত্রে উন্নতির কথা তারা বলেছে। একই সঙ্গে গণতন্ত্রের অপরিহার্য উপাদান হিসেবে নাগরিক সমাজের কাজের পূর্ণ সুযোগের ওপরও জোর দিয়েছে।

বৈঠক সূত্র জানায়, মানবাধিকার, বিশেষ করে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে ইইউ। এ সময় বাংলাদেশ বলেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে মানবাধিকার পরিস্থিতি লঙ্ঘনের কোনো অভিযোগ এলে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করা হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কয়েকটি ধারা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ইইউ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতের জন্য অনুরোধ করেছে। তখন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়, এই আইনের কোনো ধারা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করার জন্য ব্যবহার করা হবে না বলে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বৈঠকে বাংলাদেশে ও ইইউর বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। দুই পক্ষই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, সুশাসন, আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের গুরুত্ব নিয়েও কথা বলেছে।

মানবাধিকার ও সুশাসনের বিষয়টিতে ইইউ যে গুরুত্ব দিচ্ছে, তা নতুন কিছু নয় বলে মনে করেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ইউরোপ অব্যাহতভাবে এসব বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে আসছে। তবে এ বিষয়গুলোর কারণে সহযোগিতা কমবে বা ব্যবসা কমে যাবে, এমনটা মনে করার কারণ নেই। চাপ সৃষ্টির জন্য তারা এসব কথা বলতে থাকবে। বাংলাদেশকে নিজের স্বার্থেই মানবাধিকার–সুশাসনের মতো বিষয়গুলোয় উন্নতি করতে হবে এবং এটি জরুরি।