ছাত্রী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অভিযোগ এনে ক্ষতিপূরণ চেয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষকে আইনি নোটিশ পরিবারের

ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা। ছবি: সংগৃহীত
ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা। ছবি: সংগৃহীত

মায়ের গায়ের রং ফরসা, মা বেশি সুন্দর, অথচ তাঁর মেয়ে হয়েও দেখতে ততটা ভালো না, মেয়ে নিশ্চয়ই এই মা-বাবার না—এ ধরনের বুলিং (অশালীন আচরণ, মানসিক নির্যাতন) করত এক শিক্ষার্থীর কয়েকজন সহপাঠী। দিনের পর দিন এ ধরনের কথায় মেয়ের মনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ভাবতে থাকে, সে আসলেই এই মা-বাবার মেয়ে কি না। একপর্যায়ে সে আর স্কুলে যেতে চাইত না। এ কারণে স্কুলে তার উপস্থিতি কমে যায়। অনুপস্থিতির কারণ দেখিয়ে মেয়েকে ক্লাসরুম থেকে ডেকে এনে মা-বাবার উপস্থিতিতে স্কুল কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেয়, সে নতুন ক্লাসে উঠতে পারবে না, এমনকি আগের ক্লাসেও থাকা সম্ভব হবে না।

বুলিংয়ের কারণে ওই শিক্ষার্থী অস্বাভাবিক আচরণ করত। স্কুল থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনায় কিশোরী এ শিক্ষার্থীর মনে চাপ ফেলে। পরে শিক্ষার্থীকে অন্য স্কুলে ভর্তি করা হয়। তবে বাসা থেকে নতুন স্কুলে যেতে হলে আগের স্কুলের রাস্তা দিয়েই যেতে হয় বলে এ শিক্ষার্থী নতুন স্কুলেও যেতে চাইছে না। এ কারণে আপাতত এ শিক্ষার্থীর পড়াশোনা বন্ধ। মা-বাবার সঙ্গেও শিক্ষার্থীর দূরত্ব তৈরি হয়।

রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ইংরেজি মাধ্যম ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ঢাকার (আইএসডি) শিক্ষার্থী ছিল মেয়েটি। মা-বাবা স্কুল কর্তৃপক্ষের অবহেলা এবং শিক্ষার্থীর বর্তমান মানসিক পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে স্কুল কর্তৃপক্ষকে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন। এতে বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৮৫ কোটি টাকা (১০ মিলিয়ন ডলার) ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হাসান এম এস আজীম ওই ছাত্রীর মা-বাবার পক্ষে গত সোমবার ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ঢাকা কর্তৃপক্ষকে আইনি নোটিশ পাঠান। গতকাল মঙ্গলবার হাসান এম এস আজীম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সোমবার একজনের হাতে আইনি নোটিশটি দিয়ে স্কুলে পাঠাই। স্কুল কর্তৃপক্ষ ওই ব্যক্তিকে ভেতরে নিয়ে যায়। প্রায় এক ঘণ্টা সময় নেয় স্কুল কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে আইনি নোটিশের ফটোকপিও করে। তারপর জানায়, তারা নোটিশটি গ্রহণ করতে পারবে না। তবে নোটিশের আরেকটি কপি ডাকযোগে পাঠানো হয়েছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ তা গ্রহণ না করলেও আইনি ভাষায় গ্রহণ করা হয়েছে বলে বিবেচ্য হবে।’

আইনজীবী হাসান এম এস আজীম আরও বলেন, স্কুল কর্তৃপক্ষকে ১০ থেকে ১২ দিন সময় দেওয়া হবে। কোনো ব্যবস্থা না নিলে স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের মামলা করা হবে। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বুলিংয়ের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরিতে হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হবে।

এ বিষয়ে কথা বলতে আইএসডির পরিচালক টি জে কোবার্নের মুঠোফোনে একাধিক নম্বর থেকে ফোন করলেও তিনি ধরেননি। আজ বুধবার এই প্রতিবেদক এ বিষয়ে জানতে স্কুলে গেলেও ভেতরে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয়নি।

ওই শিক্ষার্থীর মা সালমা খানম প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১৭ সালে মেয়েকে গ্রেড–৭–এ ভর্তি করা হয়। মেয়ে সহপাঠীদের বুলিংয়ের বিষয়টি জানালে একাধিকবার স্কুল কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। সভা হয়েছে। তবে স্কুল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আমলে নেয়নি, উল্টো আমার মেয়েকেই বলতেন যে এমন হতেই পারে। মানিয়ে নিতে হয়। আর আমরাও ভেবেছিলাম, মেয়ে মানিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু তা হয়নি। স্কুলটির পড়াশোনার মান ভালো। তবে স্কুল কর্তৃপক্ষ আমার মেয়েকে ডেকে বের করে দেওয়ার কথা জানানোর পর মেয়ে আর তা মানতে পারেনি। মেয়ের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে।’

এই মা বারবার বলছিলেন, ‘আমার মেয়েটি অনেক ক্রিয়েটিভ। তাই অন্য দুই সন্তানকে অন্য স্কুলে দিলেও এ মেয়েকে এই স্কুলেই পড়াতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন তো আমার মেয়ের পড়াশোনাই বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের সঙ্গেও দূরত্ব তৈরি হয়েছে। স্কুলে মোবাইল নেওয়া নিষিদ্ধ নয়। শিক্ষার্থীদের হাতে দামি দামি মোবাইল। তা দেখে আমার মেয়েও দাবি করে, তাকেও দামি মোবাইল কিনে দিতে হবে। তবে আমরা অভিভাবক হয়ে ১৫ বছর বয়সী মেয়ের হাতে দামি মোবাইল তুলে দিতে পারি না। এসব নিয়েই মেয়ের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়। মেয়ের ধারণা ছিল, তার হাতে দামি মোবাইল নেই বলে অন্যরা তার বন্ধু হতে চায় না। বুলিংয়ের শিকারের ভয়ে অন্যরাও সেভাবে মিশতে পারত না মেয়ের সঙ্গে। স্কুল থেকে থাইল্যান্ডে একটি ট্রিপে গেলে বুলিংয়ের মাত্রা বাড়ে, কিন্তু শিক্ষার্থীদের সঙ্গে থাকা শিক্ষকেরা বিষয়টি আমলে নেননি।’

সালমা খানম বলেন, ‘স্কুলে গেলেও মেয়ে প্রায় দিনই স্কুল থেকে ফোন করত হয় তার পেটব্যথা, নয়তো মাথাব্যথা। সে তার স্কুলের কাউন্সেলরকেও মেইল করত। তারপর চলতি বছরের মে মাসে মেয়েকে স্কুল থেকে বের করে দিল। মেয়েকে জানিয়ে দেয়, গ্রেড–৮–এ তার প্রমোশন হবে না, এমনকি গ্রেড–৭–এ সে আরেকবার পড়তে পারবে না। আমার প্রশ্ন, আমার মেয়ে তো কোনো ক্রাইম করেনি। আর স্কুলে না যাওয়ার কারণও স্কুল কর্তৃপক্ষের অজানা নয়। স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নিচ্ছি না, তা নিয়ে মেয়ের মনে ক্ষোভ জমতে থাকে। মেয়ে কোনো রেস্টুরেন্টেও যেতে চায় না, সেখানে যদি তার আগের সহপাঠীদের কেউ দেখে ফেলে, সে ভয়ে। সবকিছু বিবেচনা করে আমরা স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছি। আমরা চাই না, স্কুলে আর কোনো বাচ্চার অবস্থা যাতে আমার মেয়ের মতো হয়।’