স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি হয়ে ভাগ্য খুলে যায় মোল্লা কাওছারের

মোল্লা কাওছার
মোল্লা কাওছার

সাদাসিধে নেতা হিসেবে পরিচিতি ছিল তাঁর। রাজনীতির পাশাপাশি গণপূর্তের ঠিকাদার হিসেবে ছোটখাটো কাজ করতেন। ঢাকার হাজারীবাগে একটি ছোট ফ্ল্যাটে স্ত্রী ও এক কন্যা নিয়ে ভাড়া থাকতেন। সংসারের টানাপোড়েন সামলাতে তাঁর স্ত্রী টুকিটাকি বুটিক ব্যবসা করতেন। কিন্তু ২০১৩ সাল থেকে বদলে যেতে থাকে তাঁর অবস্থা।

সেই তিনি হলেন মোল্লা মো. আবু কাওছার, গতকাল তাঁকে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর আলোচনায় আসেন এই নেতা। তাঁর ও পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে।

স্বেচ্ছাসেবক লীগ সূত্র জানায়, স্বেচ্ছাসেবক লীগের একসময়ের সভাপতি আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন ২০০৯ সালে। এরপরই ভাগ্য খুলে যায় আবু কাওছারের। তখন স্বেচ্ছাসেবক লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পান তিনি। ২০১২ সালের সম্মেলনে হয়ে যান সভাপতি। এরপরই কাওছারের অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। গণপূর্তের কাজে তাঁর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁর প্রভাবেই গণপূর্তের ২৬ শতাংশ কাজ পান ঠিকাদার জি কে শামীম। চলমান অভিযানের শুরুর দিকেই র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন জি কে শামীম। 

অস্ত্র ও মানি লন্ডারিং আইনের মামলায় রিমান্ড শুনানির জন্য ২ অক্টোবর দ্বিতীয় দফায় আদালতে নেওয়া হলে মোল্লা কাওছারের খোঁজ করেন জি কে শামীম। তাঁর আইনজীবীদের কাছে তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘মোল্লা কাওছার কোথায়? সে আসে নাই?’ ওই সময় একজন উত্তর দেন, ‘উনি তো নিজেই দৌড়ের ওপরে আছেন। উনি কী করে আসবেন!’

জি কে শামীম ছাড়াও গণপূর্তের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণে কাজ করেন ঢাকা কলেজের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও মোল্লা কাওছারের ভাগনে হাসান মোল্লা। গণপূর্ত বিভাগের ডিভিশন-৪–এর ভবনে ঠিকাদার সমিতির কার্যালয়ে বসে এ নিয়ন্ত্রণ করেন হাসান। গণপূর্ত সূত্র জানায়, জি কে শামীমের নজর ছিল বড় কাজের দিকে। আর ১০ কোটি টাকার নিচের কাজগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন হাসান। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন হাসান মোল্লা। তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি কার্যালয়ে বসেন। ই-দরপত্রের যুগে দরপত্র নিয়ন্ত্রণের কোনো সুযোগ নেই। চাইলে দুদক তদন্ত করে দেখতে পারে। 

২০১৬ সালের জানুয়ারিতে একাত্তর পরিবহন নামে ঢাকায় পরিবহন ব্যবসা শুরু করেন মোল্লা কাওছার। মিরপুর থেকে মতিঝিল রুটে ১০টি বাস নিয়ে যাত্রা শুরু করে একাত্তর পরিবহন। তবে এক বছরের মধ্যেই এটি বন্ধ হয়ে যায়। পরিবহন ব্যবসায় লোকসানের কথা প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেন মোল্লা কাওছার। তিনি বলেন, অংশীদারেরা দক্ষতার সঙ্গে ব্যবসা চালাতে পারেননি।

স্বেচ্ছাসেবক লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিদেশে শাখা কমিটি করায় বাড়তি আগ্রহ ছিল মোল্লা কাওছারের। এসব কমিটির বিনিময়ে সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ আছে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স, ইতালিসহ ১৫টি দেশে শাখা আছে স্বেচ্ছাসেবক লীগের। এ ছাড়া ২০১৪ সালে হঠাৎ করেই কে এম মাসুদুর রহমান নামের একজনকে কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের অর্থ সম্পাদক বানান মোল্লা কাওছার। গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার মাসুদুরের কোনো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছিল না। পদ পাওয়ার পরও গত পাঁচ বছরে স্বেচ্ছাসেবক লীগের কার্যক্রমে তাঁকে তেমনটা দেখা যায়নি। তবে তাঁর ব্যবসায় উন্নতি হয়েছে অনেক। ঢাকা থেকে গোপালগঞ্জ রুটে সেবা গ্রীন লাইন নামে পরিবহন ব্যবসা করেন তিনি। মাসুদ স্টিল মিল নামে ভারী কারখানা আছে এই ব্যবসায়ীর। তাঁর ব্যবসা সম্প্রসারণে মোল্লা কাওছারের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আছে। মাসুদুর রহমানেরও ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে এনবিআর। এ বিষয়ে কথা বলতে একাধিকবার ফোন করলেও মাসুদুর রহমান ধরেননি। তবে মোল্লা কাওছার বলেন, মাসুদুর বড় ব্যবসায়ী। এ ব্যবসার সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই।

২০১২ সালে মতিঝিলের ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সভাপতি হন মোল্লা কাওছার। ২০১৫ সালে কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর আরামবাগের ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে ক্যাসিনো চালু করেন যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মমিনুল হক সাঈদ। ক্লাবটিতে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত চলত জুয়ার আসর। গত ১৮ সেপ্টেম্বর বিকেলে এই ক্লাবে অভিযান চালায় র‍্যাব। এই ক্যাসিনোর আয়ে নিয়মিত ভাগ পেতেন আবু কাওছার। ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে অভিযানের সময় র‍্যাব কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়েছিলেন। আরও কয়েকটি ক্লাবের সঙ্গে তাঁর জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। 

ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের এক সদস্য বলেন, মোল্লা কাওছার এই ক্লাবের সভাপতি হওয়ার পরই ক্লাবটিতে অধঃপতন শুরু হয়। প্রথমে ক্লাবটি রাজনৈতিক ক্লাবে রূপ নেয়। পরে পর্যায়ক্রমে তা জুয়াঘরে পরিণত হয়। তাঁর ভয়ে ক্লাবের অন্য সদস্যরা কথা বলার সাহস পাননি। মতিঝিল থানা ঘেঁষে ক্লাবটি থাকলেও প্রশাসন তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

অভিযোগ আছে, বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার কাছ থেকেও নিয়মিত মাসোহারা নিতেন মোল্লা কাওছার। ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে ক্যাসিনো শুরুর পর আবু কাওছার তাঁর দলবল নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া সংসদ দখল করার চেষ্টা করেছিলেন। পরে এক পুলিশ কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে সব ভেস্তে যায়। আবু কাওছার নিজেকে এক পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার ঘনিষ্ঠ বলে দাবি করতেন।

গোয়েন্দা পুলিশের সূত্র জানায়, তাঁর মূল আয় ছিল টেন্ডারবাজি। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) ঠিকাদারি কাজ পেতেও দলীয় নেতাদের হয়ে সুপারিশ করতেন মোল্লা কাওছার। কেউ তাঁর সুপারিশ অগ্রাহ্য করতে পারতেন না।

প্রতিনিধি, গোপালগঞ্জ জানিয়েছেন, গোপালগঞ্জের সদর উপজেলার করপাড়া ইউনিয়নের করপাড়া গ্রামের সাবেক স্কুলশিক্ষক মোক্তার মোল্লা ও নুরুন্নাহার দম্পতির ১০ ছেলেমেয়ের মধ্যে মোল্লা কাওছার সবার বড়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে তাঁর ঢাকায় আসা। গ্রামে পুরোনো টিনের ঘর ভেঙে পাঁচ বছর আগে দোতলা বাড়ি করেছেন। সোয়া কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ২০১৪ সালে নিজের ইউনিয়নের তাড়গ্রামে একটি মাছের খামার শুরু করেন তিনি। ২০১৬ সালে খামারটিতে মাছ চাষ শুরু হয়। ১১ একর জমিতে গড়ে ওঠা খামারের জমি ধীরে ধীরে কেনা হয়েছে বলে দাবি করেন মোল্লা কাওছারের ছোট ভাই মোল্লা শাহ আলম। এ বিষয়ে মোল্লা কাওছার প্রথম আলোকে বলেন, কোনো কিছুই তো ঠিকমতো করা গেল না।

মোল্লা কাওছার ধানমন্ডিতে ভাড়া বাসায় থাকেন। দেশের বাইরে সম্পদ গড়েছেন বলে অভিযোগ আছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমেরিকায় বাড়ি, অস্ট্রেলিয়ায় বাড়ি, কত কিছুই তো শোনা যাচ্ছে। ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। তদন্ত হলেই সবকিছু বেরিয়ে আসবে। তাই অপেক্ষা করতে হবে।

আশির দশকে মোল্লা কাওছার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ডাকসুর সমাজকল্যাণ সম্পাদক ছিলেন। বাংলাদেশ আইন সমিতির সভাপতিও হয়েছেন। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় তিনি ছিলেন দেশের বাইরে। কয়েক দিন পর দেশে ফিরে আসেন।