রেলের জায়গায় দোকান বসিয়ে চাঁদাবাজি

কালাে টাকা
কালাে টাকা

গাজীপুরের জয়দেবপুরে রেলওয়ের জায়গায় সাড়ে পাঁচ শর বেশি অস্থায়ী দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। সেখান থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৮০ হাজার টাকা চাঁদা ওঠে। রেল পুলিশের সদস্য, জংশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীসহ অনেকেই ওই টাকার ভাগ নেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, জয়দেবপুর জংশনের পশ্চিমে রেলওয়ের খালি জায়গা রয়েছে। ওই জায়গা এবং রেললাইনের পাশে আগে থেকেই কিছু দোকান বসত। দুই বছর আগে দোকানগুলো উচ্ছেদ করে রেল কর্তৃপক্ষ। এরপর পশ্চিম পাশে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করে দেওয়া হয়। কিন্তু জংশনের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে বছরখানেক আগে প্রাচীরের কিছু অংশ ভেঙে ফেলা হয়। ফলে লোকজন এই পথ দিয়ে যাতায়াত শুরু করে। তখন ওই স্থানে রেলওয়ের জমিতে এবং রেললাইনের পাশে দোকান বসানো শুরু হয়। 

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, ওই স্থানে সাড়ে পাঁচ শর বেশি দোকান রয়েছে। প্রায় ৩০০টি দোকান ছোট আকৃতির। তুলনামূলক বড় দোকান রয়েছে আড়াই শতাধিক। ছোট দোকানগুলো ১০ ফুট বাই ৫ ফুটের। বড়গুলো ১৫ ফুট বা ১০ ফুটের। বেশির ভাগ দোকানেই টিনের ছাউনি। কিছু দোকানের ওপরে বাঁশের বেড়া ও পলিথিন দেওয়া। প্রতিটি দোকানই বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। দোকানের ভেতরে খাট বসিয়ে মালামাল সাজানো। অধিকাংশই জুতা, কাপড়, খাবার হোটেল, ফল, চা, মুদি ও খেলনার দোকান। অনেক দোকান ঝুঁকিপূর্ণভাবে রেললাইনের পাশে বসানো হয়েছে। জংশন এলাকায় এত দোকান দেখে মনে হতে পারে এটি কোনো বাণিজ্যিক এলাকা।

জয়দেবপুর জংশন দিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করেন মোবারক হোসেন। তিনি বলেন, এসব দোকান বসিয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগ তো রয়েছেই, পাশাপাশি এখানে মাদকসেবীদের আড্ডা বসে। পরিবেশও নষ্ট হচ্ছে। মধ্যে দু-একবার উচ্ছেদ করা হয়েছিল এসব দোকান। কিন্তু অনেকটা লোকদেখানো। সপ্তাহ না পেরোতেই আবার দোকান বসানো হয়।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানে দোকান বরাদ্দ নেওয়ার জন্যও টাকা লাগে। প্রতিটি ছোট দোকানের জন্য আড়াই হাজার টাকা এবং অপেক্ষাকৃত বড় দোকানের জন্য পাঁচ হাজার টাকা করে দিতে হয়েছে। এককালীন এই টাকার বাইরে দোকানের আকৃতি অনুযায়ী প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের চাঁদা দিতে হয়। এর বাইরে মাসিক কোনো টাকা দিতে হয় না।

কাপড় ব্যবসায়ী হাশেম মিয়া বলেন, তুলনামূলক বড় দোকানের জন্য দিনে ১৬৫ টাকা আর ছোট দোকানের জন্য ১০০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। এর ব্যতিক্রম করলে সংশ্লিষ্ট দোকানিকে উঠিয়ে দিয়ে নতুন কাউকে বরাদ্দ দেওয়া হয়। আরেক কাপড় বিক্রেতা সাইফুল ইসলাম বলেন, ঝড়বৃষ্টির কারণে অনেক সময় দোকান ঠিকমতো চলে না। আবার অন্যান্য কারণেও মাঝেমধ্যে দোকান বন্ধ রাখতে হয়। তবে চাঁদা থেকে নিস্তার নেই। প্রতিদিন টাকা না দিলে দোকান বন্ধ করে দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়।

জংশন এলাকায় দোকানঘর বরাদ্দ দেওয়া এবং প্রতিদিন টাকা তোলার মূল দায়িত্বে রয়েছেন চা বিক্রেতা বাচ্চু মিয়া এবং জুতা বিক্রেতা তাজু মিয়া। এই দুজন মিলে মার্কেট কমিটি গঠন করেছেন। বাচ্চু নিজেকে এই কমিটির সভাপতি বলে পরিচয় দেন। তাঁরা কিছু লোক নিয়োগ করেছেন, যাঁরা প্রতিদিন দোকান থেকে চাঁদা তোলেন। এ ছাড়া ভাসমান হকারদের কাছ থেকে গড়ে প্রতিদিন নেওয়া হচ্ছে কয়েক হাজার টাকা। সব মিলিয়ে প্রতিদিন গড়ে কমপক্ষে ৮০ হাজার টাকা ওঠে। বাচ্চু মিয়া এসব টাকা বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ-বাঁটোয়ারা করেন। তিনি বিষয়টি স্বীকারও করেছেন। 

বাচ্চু মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, দোকান বরাদ্দের জন্য একেকজনের কাছ থেকে একেক রকম টাকা নেওয়া হয়। আর প্রতিদিন ছোট দোকান থেকে ১০০ এবং বড় দোকান থেকে ১৬৫ টাকা তোলা হয়। এসব টাকা দিয়ে নৈশপ্রহরীদের বেতন দিতে হয়। তিনি আরও বলেন, ‘এই টাকা আমি একা খাই না, রেল পুলিশ নেয়, স্টেশনের কর্মকর্তাগো দিতে হয়। আর আওয়ামী লীগের কিছু নেতা-কর্মী তো বিকেল হলে টাকার জন্য বসেই থাকে।’ তবে চাঁদার ভাগ নেওয়া ব্যক্তিদের নাম প্রকাশে অস্বীকৃতি জানান তিনি।

জয়দেবপুর জংশনের স্টেশনমাস্টার মো. শাহজাহান মিয়া বলেন, জংশন এলাকায় স্থায়ী কিছু দোকান আছে। সেগুলো রেলওয়ের বিধি অনুযায়ী বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রতি মাসে সেখান থেকে রাজস্ব আসে সাড়ে তিন লাখ টাকা। ওই টাকা ব্যাংকে জমা দেওয়া হয়। এর বাইরে অবৈধ অনেক দোকান গড়ে উঠেছে। সেগুলো কয়েকবার উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপরও ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে অনেকে দোকান বসিয়ে নিচ্ছে। রেলস্টেশনের কেউ সেখান থেকে টাকা নেয় কি না সেটা তাঁর জানা নেই। 

জয়দেবপুর জংশন ফাঁড়ির সহকারী পরিদর্শক (এসআই) মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘আমি তিন মাস হলো এখানে যোগদান করেছি। অবৈধ দোকান উচ্ছেদের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। বড় অভিযান ছাড়া এগুলো উচ্ছেদ করা কঠিন। আর পুলিশের টাকা নেওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই।’