হয়রানির হাতিয়ার 'ভুয়া পরোয়ানা'

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

মাদারীপুরের রাবুল মাতুব্বারকে ২০১২ সালে করা উত্তরা পূর্ব থানার একটি মামলায় ১৭ অক্টোবর গ্রেপ্তার করে মাদারীপুরের পুলিশ। মাদারীপুরের একটি আদালত তাঁকে জেলা কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। ওই মামলার কাগজপত্র নিয়ে রাবুল মাতুব্বারের আইনজীবী ঢাকার আদালতে জামিনের আবেদন করলে জানা যায়, পরোয়ানাটি ভুয়া। গত মঙ্গলবার ঢাকার আদালত থেকে তাঁকে মুক্ত করার আদেশ দেওয়া হলেও মাদারীপুর কারাগারে কাগজপত্র না পৌঁছানোয় বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁর মুক্তি মেলেনি।

কেবল রাবুলই নন, আদালতপাড়ায় প্রায়ই এ রকম ভুয়া পরোয়ানার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে এ পর্যন্ত ৫৪ দিনে ভুয়া পরোয়ানায় ১০টি ঘটনা ধরা পড়েছে। এর মধ্যে ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত-২-এ ধরা পড়েছে পাঁচটি ঘটনা। গ্রেপ্তার বা আত্মসমর্পণের পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আদালতে আসার পরই কেবল বিষয়গুলো জানা যাচ্ছে। এতে আসামি না হয়েও গ্রেপ্তার হয়ে কারাবাস করতে হচ্ছে অনেককেই। আদালতের নজরে আসার পর কেউ কেউ মুক্তি পেয়েছেন।

রাবুল মাতুব্বারের আইনজীবী আবদুল আওয়াল বলেন, ২০১২ সালে উত্তরায় ককটেল বিস্ফারণের মামলায় গত ১৫ জুন রাবুল মাতুব্বারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। মামলাটিতে মহানগর হাকিম শাহাদত হোসেনের স্বাক্ষর রয়েছে। কিন্তু তিনি খুঁজে দেখেন, শাহাদত হোসেন নামে কোনো বিচারক এই আদালতে ছিলেন না, ১৫ জুনের কোনো আদেশও নেই। বিষয়গুলো তিনি গত মঙ্গলবার ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত-২-এ তুলে ধরলে শুনানি শেষে বিচারক কেশব রায় চৌধুরী মুক্তির আদেশ দেন।

আইনজীবীরা বলছেন, আদালতের সব ধরনের সিল, স্বাক্ষরসহ এসব পরোয়ানা একটি মহল সংশ্লিষ্ট থানায় পাঠাচ্ছে। থানার পুলিশ নিয়মানুযায়ী পরোয়ানা তামিল, অর্থাৎ আসামি গ্রেপ্তার করছে। পুলিশের যাচাই করার কোনো উপায় থাকছে না সেই পরোয়ানা আসল না ভুয়া। আর একবার গ্রেপ্তার হলে সেই লোককে কারাবাসসহ ব্যাপক আইনি ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। অথচ তিনি কোনো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত নন।

>

৫৪ দিনে ১০টি ভুয়া পরোয়ানার ঘটনা ধরা পড়েছে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে

আইনজীবী নেতা কাজী নজীবুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, একটি পরোয়ানায় যা যা থাকে, সবই থাকে ভুয়া পরোয়ানায়। থানার পুলিশ এসব পরোয়ানা তামিল করতে বাধ্য। ভুয়া পরোয়ানা দেখে বোঝার উপায় নেই। তাতে বিচারকের সই ও মোহর সবই থাকে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে জালিয়াত চক্র ভুয়া পরোয়ানাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।

আদালত সূত্র জানায়, আদালত থেকে কোনো আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হলে তা প্রথমে আদালতের নাজির শাখায় পাঠানো হয়। ওই শাখা নিবন্ধন খাতায় মামলার নম্বর, মামলার ধারা এবং আসামির নাম-ঠিকানা লেখা হয়। এর স্মারক নম্বর দিয়ে পুলিশের প্রসিকিউশন বিভাগের উপকমিশনারের দপ্তরে পাঠানো হয়। প্রসিকিউশন শাখা নতুন স্মারকে পুলিশ সদর দপ্তরের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট থানায় পরোয়ানা পাঠায়। এতগুলো স্তর পেরিয়ে কীভাবে ভুয়া পরোয়ানা থানাগুলোতে যাচ্ছে, জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের প্রসিকিউশন বিভাগের উপকমিশনার জাফর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আদালত এলাকায় কাজ করেন, হতে পারে পুলিশের কোনো সদস্য, আদালতের সহকারী, আইনজীবীর সহকারী, এমন কারও সহায়তা ছাড়া একজন সাধারণ ব্যক্তির পক্ষে ভুয়া পরোয়ানা তৈরি করা সম্ভব নয়।

কুমিল্লার বরুড়ার স্টুডিও ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির খবর পেয়ে ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। এরপর জানা গেল, পরোয়ানায় যে মামলার কথা উল্লেখ রয়েছে, আদতে এর কোনো অস্তিত্বই নেই। মিজানুরের বিষয়ে আদালতের আদেশে বলা হয়, ভুয়া পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। যারা পাঠাচ্ছে, তাদের চিহ্নিত করা যাচ্ছে না।

ঢাকার আদালতের সরকারি কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু বলেন, ভুয়া পরোয়ানায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের জামিনে বেরিয়ে আসতেও নানা জটিলতা দেখা দেয়। আদালতে যাওয়ার পর অনেক সময় নথিপত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। দিনের পর দিন বিনা বিচারে কারাগারে থাকতে হয়।

আইনজীবী কাজী নজীবুল্লাহ মনে করেন, আদালতের আদেশের কাগজপত্র পাঠানোর ক্ষেত্রে পুলিশ যদি ডাক বিভাগে পৃথক শাখার ব্যবস্থা করতে পারে, তাহলে এ ধরনের জালিয়াতি কমে আসবে।