পুলিশের তথ্য-উপাত্তে গরমিল পেল মানবাধিকার কমিশন

রাজশাহী
রাজশাহী

রাজশাহীর শাহ্ মখদুম থানা থেকে বেরিয়ে কলেজছাত্রী লিজা রহমানের গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহননের ঘটনায় পুলিশের দেওয়া তথ্য-উপাত্তে গরমিল পেয়েছে মানবাধিকার কমিশনের তদন্তকারী প্রতিনিধিদল।

তদন্ত শেষে আজ শুক্রবার সকালে রাজশাহী ত্যাগ করার আগে রাজশাহী বন বিভাগের রেস্ট হাউসে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের পরিচালক (অভিযোগ তদন্ত) আল মাহমুদ ফয়জুল কবির এসব কথা বলেন।

এই প্রতিনিধিদলের চার সদস্য রাজশাহীতে এসে পুলিশ, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের কর্মচারী, লিজা রহমানের পরিবারের সদস্যসহ ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য নেন।

প্রতিনিধিদলের প্রধান আল মাহমুদ ফয়জুল কবির সাংবাদিকদের বলেন, প্রাথমিকভাবে পুলিশের দেওয়া তথ্য-উপাত্তে গরমিল পাওয়া গেছে। থানা থেকে বলা হয়, লিজা রহমান সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে এসে তাঁদের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে নাম লিখে চলে যান। কিন্তু কমিশনকে দেওয়া জিডির কপিতে লিজার শ্বশুর–শাশুড়ির নাম পাওয়া গেছে। লিজা তাঁর মৃত্যুর আগে ভিডিও বার্তায় বলে গেছেন, থানায় তাঁর মামলা না নেওয়া ও তাঁর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার কারণেই তিনি আত্মহত্যার এ পথ বেছে নেন। তাঁরা পুলিশের দেওয়া তথ্য-উপাত্ত, ভিডিও, জিডির কপি ও সাক্ষ্যের বক্তব্যে গরমিল পেয়েছেন।

আল মাহমুদ ফয়জুল কবির বলেন, ‘আমাদের তদন্তে একটু দেরি হয়েছে। আমরা আগামী কিছুদিনের মধ্যে এটি প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করব। তখন বিস্তারিত বলা হবে।’ এখানে পুলিশের ভূমিকা আরও সহনশীল হওয়ার কথাও এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হবে বলে জানান তিনি।

রাজশাহী মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) সালমা বেগম তাঁর প্রতিবেদনে বলেন, সেখানে কোনো ধরনের পুলিশের গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে দাপ্তরিক কাজের গাফিলতির অভিযোগ আনা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। নিজের নিরাপত্তার জন্য ওসি ঘটনাটির একটি জিডি করে রাখতে পারতেন।

গত ২৮ সেপ্টেম্বর লিজা রহমান তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে রাজশাহী নগরের শাহ্ মখদুম থানায় অভিযোগ করতে গিয়ে ফিরে আসেন। থানা থেকে খানিকটা দূরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে তিনি প্রকাশ্যে নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেন। পরে তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য পুলিশি ব্যবস্থাপনায় ঢাকায় পাঠানো হয়। ঢাকায় শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারিতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২ অক্টোবর তাঁর মৃত্যু হয়। ওই দিন রাতেই লিজা রহমানের বাবা মো. আলম বাদী হয়ে রাজশাহী নগরের শাহ্ মখদুম থানায় আত্মহত্যার প্ররোচনার একটি মামলা করেন। মামলা করার জন্য তাঁকে গাইবান্ধা থেকে পুলিশ গাড়িতে করে রাজশাহীতে এনেছিল। মামলা শেষে আবার তাঁকে গাড়িতে করেই গাইবান্ধায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।

মামলায় লিজা রহমানের স্বামী সাখাওয়াত হোসেন, তাঁর বাবা মাহাবুবুল আলম, মা নাজনীন বেগম ও তাঁদের নিকটাত্মীয়দের আসামি করা হয়েছে।

ঘটনার পর পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, লিজা রহমান প্রথমে নগরের শাহ্‌ মখদুম থানায় অভিযোগ করতে যান। বিষয়টি শোনার পর পুলিশের এক নারী কনস্টেবলকে দিয়ে তাঁকে তাঁদের থানা–সংলগ্ন ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি পরে অভিযোগ করবেন বলে বেরিয়ে আসেন। সেখান থেকে নগরের মহিলা কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্রের গেটের বিপরীতে ফুটপাতে নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে ম্যাচের আগুন দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। এজাহারে বলা হয়েছে, শ্বশুর, শাশুড়ি ও তাঁদের নিকটাত্মীয়ের দেওয়া মিথ্যা অপবাদ সইতে না পেরে আত্মহত্যার জন্য আগে থেকেই তাঁর ভ্যানিটি ব্যাগে থাকা একটি সেভেন আপের বোতলে কেরোসিন নিয়ে যান।

লিজা রহমানের বাড়ি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায়। তিনি রাজশাহী মহিলা কলেজের উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশোনা করতেন। লিজা তাঁর বাবার পালিত সন্তান। নিজের ইচ্ছায় আদালতের মাধ্যমে বিয়ে করেছিলেন। তাঁর স্বামীর নাম সাখাওয়াত হোসেন (২২)। সাখাওয়াত রাজশাহী সিটি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। সাখাওয়াতের গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলায়।

ছেলের পরিবার বিয়ে মেনে না নেওয়া এবং ছেলের পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁর মাকে হুমকি দেওয়ার ঘটনা নিয়ে স্বামীর সঙ্গে মতবিরোধ হয় লিজার। মামলার পরে পুলিশ তাঁর স্বামী সাখাওয়াত হোসেনকে গ্রেপ্তার করে।