দক্ষিণাঞ্চলে বর্ষায় বৃষ্টি হয়েছে অত্যন্ত কম

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলে এবার বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিকের চেয়ে অত্যন্ত কম বৃষ্টি হয়েছে। এই সময়ে স্বাভাবিকের চেয়ে তাপমাত্রা বেশি ছিল গোটা অঞ্চলে। এপ্রিলের শুরু থেকেই বেশি ছিল তাপমাত্রা। বর্ষায় খুব একটা হেরফের হয়নি। বর্ষা মৌসুম শেষে শরতেও এই তাপমাত্রা তেমনটা কমেনি।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এবার কম বৃষ্টি হয়েছে। এতে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ-প্রকৃতি ও কৃষিক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, জুনে বরিশালে স্বাভাবিক বৃষ্টি হওয়ার কথা ৪০৮ দশমিক ৪ মিলিমিটার; কিন্তু হয়েছে মাত্র ১৪৭ দশমিক ৭ মিলিমিটার। জুলাইয়ে অবশ্য স্বাভাবিকের চেয়ে সামান্য বেশি বৃষ্টি হয়েছে। আগস্টে বৃষ্টি অনেক কম হয়েছে। এই মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টি হওয়ার কথা ৩৭১ দশমিক ৩ মিলিমিটার; হয়েছে ২৫৭ মিলিমিটার। সেপ্টেম্বরে ২৫৯ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হওয়ার কথা থাকলেও হয়েছে ১৭৯ মিলিমিটার।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের বরিশাল কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক আনিসুর রহমান বলেন, গত বছর এপ্রিলে স্বাভাবিকের চেয়ে ৩৬ দশমিক ৭ মিলিমিটার, মে মাসে ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু এবার বৃষ্টির পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কম। এবার এপ্রিল-মে মাসে তীব্র গরমের পর জুনে বেশি বৃষ্টিপাতের আশা করা হলেও তা হয়নি। ফলে এই অঞ্চলে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তাপমাত্রা বিরাজ করছে। আবহাওয়ার এই বিরূপ আচরণ অস্বাভাবিক। এপ্রিলে এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল স্বাভাবিকের প্রায় অর্ধেক।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ১৪ এপ্রিল থেকে পুরো মে মাস পর্যন্ত দক্ষিণাঞ্চলে তাপমাত্রা ৩৪ থেকে ৩৬ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করেছে। এরপর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে তা ৩৫ ডিগ্রির ওপরে ছিল। দীর্ঘ সময় ধরে অধিক তাপমাত্রার এমন চিত্র আগে কখনো অনুভূত হয়নি বলে জানান আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তা। দিনের বেলা তপ্ত রোদ। গরমের দাপট কমছে না রাতেও।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জুনে বরিশালে গড়ে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকার কথা ৩১ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এবার তা ছিল ৩৫ দশমিক ৬ ডিগ্রি। জুলাইয়ে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকার কথা ৩০ দশমিক ৮ ডিগ্রি, সেখানে তাপমাত্রা ছিল ৩৫ দশমিক ৫ ডিগ্রি। আগস্টে থাকার কথা ৩০ দশমিক ৯, সেখানে ছিল ৩৪ দশমিক ২ ডিগ্রি। সেপ্টেম্বরে থাকার কথা ৩১ দশমিক ৬, সেখানে ছিল ৩৫ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

আনিসুর রহমান বলেন, বৃষ্টিপাত এবং তাপমাত্রার এমন বিরূপ আচরণ বেশ কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে। ২০১৬ সালের জুন মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছিল। জুলাই মাসে ১৩ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়। পরের দুই মাস আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে আবার বৃষ্টির মাত্রা কমে যায়। ২০১৭ সালের এই চার মাসে দক্ষিণাঞ্চলে বৃষ্টি হয়েছে স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ২০ শতাংশ বেশি। আবার ২০১৮ সালে বৃষ্টিপাত কমে যায়। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদি তাপপ্রবাহের ফলে জনস্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এতে মানুষের কর্মক্ষমতা হ্রাস, মেজাজ বিগড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বৃষ্টির পরিমাণ কমে যাওয়ায়  উপকূলে লবণাক্ততার প্রভাব বাড়বে। ফলে কৃষি উৎপাদনে মারাত্মক বিপর্যয় হতে পারে। একই সঙ্গে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় এবার দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীতে ইলিশের ভরা মৌসুমেও তেমন ইলিশ পাওয়া যায়নি।

আন্তর্জাতিক মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ফিশ বাংলাদেশের ইকোফিশ প্রকল্পের প্রধান অধ্যাপক আবদুল ওয়াহাব প্রথম আলোকে বলেন, নদ-নদীতে ইলিশ কম পাওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে। তবে এর মধ্যে অন্যতম কারণ বৃষ্টি কম হওয়া। কারণ, ইলিশের প্রজনন ও বিচরণ বৃষ্টির সঙ্গে সম্পর্কিত।

বাড়ছে লবণাক্ততা, কৃষিতে বিপর্যয়ের শঙ্কা

পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা পাল্টেছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণেই বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমছে এবং শীত ঋতুতেও অস্বাভাবিক তাপমাত্রা অক্ষুণ্ন থাকছে। এ জন্য অসময়ে বেশি বৃষ্টি এবং মৌসুমে স্বাভাবিক বৃষ্টি না হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে।

মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই) বরিশাল আঞ্চলিক কার্যালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, দক্ষিণাঞ্চলের ফসলি জমিতে লবণাক্ততার মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। ২০১৩ সালের গবেষণায় দেখা যায়, বরিশাল বিভাগের ৭ লাখ ৪১ হাজার ৩১০ হেক্টর কৃষিজমির মধ্যে ৩ লাখ ৯৪ হাজার ১৮০ হেক্টর জমিতে অতিমাত্রায় লবণাক্ততা পাওয়া গেছে।

ওই কার্যালয়ের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সাব্বির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বৃষ্টি কমে যাওয়ায় লবণাক্ততা ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। ২০১৩ সালের পর এ নিয়ে বড় ধরনের পরীক্ষা হয়নি। তবে সীমিত আকারে সম্প্রতি পাঁচ জেলার বেশ কিছু এলাকার পানি ও মাটি পরীক্ষার পর প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, লবণাক্ততার মাত্রা আগের চেয়ে আরও বেড়েছে। আশঙ্কার ব্যাপার হলো, বলেশ্বর নদে বর্ষা মৌসুমেও অস্বাভাবিক লবণাক্ততা কখনো ছিল না। দুই বছর ধরে এই নদের পাথরঘাটার চরদুয়ানি থেকে পিরোজপুর পর্যন্ত অস্বাভাবিক লবণাক্ততা।

কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বরিশাল আঞ্চলিক কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এবার টানা কয়েক মাস ধরে অধিক তাপমাত্রার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। বৃষ্টির পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে দক্ষিণাঞ্চলে। এটা কৃষির জন্য অশনিসংকেত। কারণ, বৃষ্টিপাত কম হলে মাটিতে লবণাক্ততা বাড়বে। শস্যের আবাদ কমে যাবে।