শতবর্ষী অস্ট্রিচের ইজারা হয়ে গেল

অস্ট্রিচে মেরামতের কাজ চলছে। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকার পূর্বগ্রাম বাজারের কর্নেলের ডকে।  ছবি: প্রথম আলো
অস্ট্রিচে মেরামতের কাজ চলছে। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকার পূর্বগ্রাম বাজারের কর্নেলের ডকে। ছবি: প্রথম আলো

বৃদ্ধ মা-বাবা, দাদা-দাদিকে অনেকেই পরিবারের ‘বোঝা’ মনে করেন। এই বোঝা থেকে রেহাই পেতে কেউ কেউ পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেন। বিআইডব্লিউটিসির নৌবহরের সবচেয়ে বয়সী সদস্য অস্ট্রিচকে অনেকটা সেই অবস্থাই বরণ করতে হয়েছে। আয়-রোজগার করতে না পারায় প্রায় শতবর্ষী অস্ট্রিচ এখন বিআইডব্লিউটিসির কাছে বোঝা। এই অজুহাতে ঐতিহাসিক এই জাহাজটিকে ইজারা দিয়ে দেওয়া হয়েছে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে।

বিআইডব্লিউটিসি (বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থা) সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে অস্ট্রিচসহ আরও তিনটি প্যাডেল স্টিমারকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ করার জন্য ইউনেসকোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। ইউনেসকো তাতে সম্মত হয়ে স্টিমারগুলোর ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজ ও এ-সম্পর্কিত একটি তথ্যচিত্র পাঠানোর কথা বলে। তবে মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত এর কিছুই করতে পারেনি।

ইতিমধ্যে বিআইডব্লিউটিসি প্যাডেল স্টিমার পিএস অস্ট্রিচ, পিএস মাহসুদ, পিএস লেপচা ও পিএস টার্নকে রাষ্ট্রীয় ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। এর অংশ হিসেবে ১৫ অক্টোবর অস্ট্রিচের একটি রেপ্লিকা জাতীয় জাদুঘরের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। জাদুঘর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে রেপ্লিকাটি জাদুঘরের ১১ নম্বর গ্যালারিতে বসানো হবে। এত সব সম্মানজনক আয়োজনের মধ্যেই এ বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি বর্ষীয়ান অস্ট্রিচকে ১ লাখ ৩২ হাজার টাকা মাসিক ভাড়ায় ইজারা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইজারা নিয়েছে অ্যাকর্ট রিসোর্সেস নামের একটি প্রতিষ্ঠান। পাঁচ বছর মেয়াদি এই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, বিআইডব্লিউটিসি প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে জামানত হিসেবে নিয়েছে ১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা।

অস্ট্রিচ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক বলেই বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তাদের অনেকে মনে করেন, ইজারা না দিয়ে স্টিমারটি মেরামতের মাধ্যমে সুসজ্জিত করে সরকারিভাবে পর্যটনের কাজে ব্যবহার করা যেত।

জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান সৈয়দ তাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের নৌবহরে নতুন নতুন জাহাজ আসছে। সেখানে প্যাডেল ইঞ্জিনগুলো চালাতে গিয়ে বিস্তর লোকসান গুনতে হচ্ছিল। সে জন্যই অস্ট্রিচকে ইজারা দিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

>

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথসহ বিশ্ববরেণ্য অনেক নেতা অস্ট্রিচে চেপে নদী ভ্রমণ করেছেন।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ইজারাদার অ্যাকর্ট রিসোর্সেসের মালিক খাদিমুল ইসলাম। জাহাজটি ইজারা পাওয়ার ক্ষেত্রে দেনদরবারে তাঁকে সহযোগিতা করেছেন তাঁর স্ত্রী নাজমা আখতার। তিনি আওয়ামী যুব মহিলা লীগের সভাপতি। জানতে চাইলে নাজমা আখতার বলেন, ‘অস্ট্রিচ অনেকটাই অকেজো অবস্থায় পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। তাই আমরা এটিকে মেরামত করে পর্যটনের কাজে লাগানোর জন্য ইজারা নিয়েছি। আমরা না নিলে জাহাজটি পড়ে থেকে পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যেত।’

ইতিহাসের অংশ অস্ট্রিচ
জাহাজটি ১৯২৯ সালে কলকাতার গার্ডেন রিচ শিপইয়ার্ডে নির্মিত হয়। বেলজিয়াম সরকারের আর্থিক অনুদান ও কারিগরি সহায়তায় ১৯৮৩ সালে জাহাজটিকে স্টিম পদ্ধতি থেকে ডিজেলচালিত পদ্ধতিতে রূপান্তর করা হয়। ১৯৯৬ সালে জাহাজটিতে রিডাকশন গিয়ার সংযোজন করা হয়। স্টিমারটির দুই পাশে কয়েকটি করে পাখা আছে, যা প্যাডেলের মতো ঘোরে এবং জাহাজকে পানিতে চলতে সাহায্য করে। বিআইডব্লিউটিসির প্রকৌশলীদের মতে, এই পাখার কারণেই বড় ধরনের ঝড়-বৃষ্টিতেও স্টিমারটি নিখুঁতভাবে ভারসাম্য ধরে রাখতে পারে। ঢাকা-খুলনাসহ অন্যান্য রুটে প্রায় শত বছরের যাত্রায় স্টিমারটি কখনোই বড় কোনো দুর্ঘটনার শিকার হয়নি।

আশির দশক পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অস্ট্রিচের কদর ছিল ব্যাপক। বিদেশি রাষ্ট্রীয় অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্য এই অস্ট্রিচে চড়িয়ে তাঁদের ঘোরানো হতো। বিআইডব্লিউটিসি সূত্র জানায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথসহ বিশ্ববরেণ্য অনেক নেতা অস্ট্রিচে চেপে নদী ভ্রমণ করেছেন।

অস্ট্রিচ দৈর্ঘ্যে ২২৫ ফুট এবং চওড়ায় ৩০ ফুট। এর গতিবেগ ঘণ্টায় ১০ নটিক্যাল মাইল। এটি ৯০০ যাত্রী ও ১৫০ টন পণ্যসামগ্রী বহনে সক্ষম।

নেই শুধু অস্ট্রিচ
অস্ট্রিচ না থাকলেও প্যাডেল স্টিমার পিএস মাহসুদ, পিএস লেপচা ও পিএস টার্ন এখনো বিআইডব্লিউটিসির নৌবহরে আছে। এর মধ্যে মাহসুদ ১৯২৯ সালে, লেপচা ১৯৩৮ সালে এবং টার্ন ১৯৫০ সালে নির্মিত হয়। সব কটিই নির্মিত হয় কলকাতার গার্ডেন রিচ শিপইয়ার্ডে। বুড়িগঙ্গার বাদামতলী ঘাটে গেলে এই তিন স্টিমারকে প্রায়ই দেখা যায়। দেখা যায় না শুধু অস্ট্রিচকে।

অস্ট্রিচ এখন শীতলক্ষ্যায়। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকার পূর্বগ্রাম বাজারের কর্নেলের ডকে নোঙর করে আছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, অস্ট্রিচে মেরামতের কাজ চলছে। ডকের কর্মীরা জানান, স্টিমারটি ওপরের অংশের কেবিনগুলো ভেঙে নতুন করে সাজানো হচ্ছে।

অ্যাকর্ট রিসোর্সেসের মালিক খাদিমুল ইসলামের ভাষ্য, স্টিমারটির মূল কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি।