প্লাস্টিকের বেতি বুনে জীবিকার নতুন পথ

প্লাস্টিকের বেতি দিয়ে তৈরি ডোল।  ছবি: প্রথম আলো
প্লাস্টিকের বেতি দিয়ে তৈরি ডোল। ছবি: প্রথম আলো

কয়েক বছর আগেও গ্রামাঞ্চলে ধানের ডোল, ঘরের বেড়া আর রান্নাঘরের ছাউনিতে ব্যবহৃত হতো বাঁশের বেতি। এখন সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে প্লাস্টিকের বেতি। আর ঢাকার ধামরাইয়ে প্লাস্টিকের বেতি বুনে ডোল ও ধারাও তৈরি করছেন শ্রমিকেরা। এভাবে বেশ লাভবান হচ্ছেন শ্রমিকেরা। 

গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একসময় ধান ওঠার মৌসুমে গ্রামের বাজার ও মফস্বল শহরে হাটের দিনে বাঁশের বেতির তৈরি ডোল বিক্রি হতো। কৃষকেরা এসব ডোল কিনে নিতেন ধান ও অন্যান্য শস্য সংরক্ষণের জন্য। এ ছাড়া বিভিন্ন দোকানে মিলত বাঁশের বেতের ধারা। গ্রামের কম আয়ের মানুষেরা ঘরের বেড়া ও রান্নাঘরের ছাউনিতে ওই ধারা ব্যবহার করতেন। কিন্তু এখন গ্রামের হাট-বাজারগুলোতে বাঁশের তৈরি ধারা আর ডোল তেমন চোখে পড়ে না। বাঁশের বেতির পরিবর্তে পাওয়া যায় প্লাস্টিকের বেতির ধারা আর ডোল। তাঁরা আরও জানান, আগে বিভিন্ন এলাকায় দরিদ্র পরিবারের নারীরা গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি বাড়তি আয়ের জন্য বাঁশের বেতির ধারা ও ডোল বানাতেন। পুরুষ সদস্যরা দিনমজুরির পাশাপাশি সপ্তাহে বা পনের দিনে এক দিন ওই সব ধারা ও ডোল স্থানীয় হাট-বাজারে নিয়ে বিক্রি করতেন। এভাবে দুজনের আয়ে অনেকের পরিবারই সচ্ছলভাবে চলত। কিন্তু এখন নারীরা গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়ে কারখানায় কাজ করেন। ফলে বাঁশের বেতির শিল্প প্রায় বিলুপ্তির পথে। তবে কয়েক বছর ধরে প্লাস্টিকের বেতির প্রচলন বেড়ে গেছে। এতে তাঁদের উপার্জনের পথ আরও প্রসারিত হয়েছে।

ঢাকার ধামরাইয়ের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে প্লাস্টিকের বেতির ডোল আর ধারা তৈরি করতে দেখা যায়। নারী ও পুরুষ একসঙ্গে প্লাস্টিকের বেতির কাজ করেন। এই শিল্পের সঙ্গে যুক্তরা অধিকাংশই দেশের উত্তর–দক্ষিণাঞ্চলের বাসিন্দা। তাঁরা রাজধানীর আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় থেকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে প্লাস্টিকের বেতির ডোল ও ধারা তৈরির কাজ করেন।

প্লাস্টিকের বেতি দিয়ে ধারা বানাচ্ছে। সম্প্রতি ধামরাইয়ের সুয়াপুরে।  ছবি: প্রথম আলো
প্লাস্টিকের বেতি দিয়ে ধারা বানাচ্ছে। সম্প্রতি ধামরাইয়ের সুয়াপুরে। ছবি: প্রথম আলো

ধামরাইয়ের সুয়াপুর বাজারের পাশে প্লাস্টিকের বেতির ডোল আর ধারা তৈরির কাজ করেন সাতক্ষীরার লিটন-চম্পা মাখাল দম্পতি। তাঁরা বছরখানেক আগে সাতক্ষীরা থেকে এসে সুয়াপুরের আটআনি পাড়ায় একটি কক্ষ ভাড়া নেন। এরপর থেকে তাঁরা চুক্তির ভিত্তিতে এক ব্যবসায়ীর প্লাস্টিকের বেতির ডোল ও ধারা তৈরির কাজ করছেন। এই দম্পতির মতো বেশ কয়েকটি পরিবারের সদস্যরা ধামরাইয়ের বিভিন্ন এলাকায় ডোল ও ধারা তৈরির কাজ করছেন, যাঁদের বাড়ি সাতক্ষীরায়।

লিটন মাখাল বলেন, তাঁদের ২৫ টাকা কেজি দরে ধারা আর ৪০ টাকা কেজি দরে ডোলের পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। প্রতিদিন তাঁরা দুজনে ৩০ কেজি ডোল আর ২৫ কেজি ধারা বানাতে পারেন। কোনো কোনো দিন এর বেশিও হয়। এ থেকে তাঁদের দিনে গড় আয় ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা।

বাঁশের বেতির পরিবর্তে প্লাস্টিকের বেতির ডোল আর ধারার ব্যবহার বাড়ার বিষয়ে ব্যবহারকারীদের অনেকে বলেন, বাঁশের বেতির ধারা শোবার ঘরের বেড়া আর রান্নাঘরের ছাউনিতে ব্যবহার করলে বৃষ্টির পানিতে ভিজে কয়েক মাসেই নষ্ট হয়ে যেত বা এগুলো উইপোকায় খেয়ে ফেলত। কিন্তু
প্লাস্টিকের বেতির ধারা কয়েক বছরেও নষ্ট হয় না। প্লাস্টিকের বেতির ডোলও অনেক টেকসই। এ কারণে গ্রামে প্লাস্টিকের বেতির ধারা আর ডোলের ব্যবহার বাড়ছে।

তিন বছরের বেশি সময় ধরে প্লাস্টিকের বেতির ডোল ও ধারার ব্যবসা করছেন সুয়াপুর বাজারের ব্যবসায়ী ভীষ্মচন্দ্র মনিদাস। তিনি বলেন, বিভিন্ন কারখানা থেকে তিনি প্লাস্টিকের তৈরি বেতি সংগ্রহ করেন। বিদেশ থেকে যেসব যন্ত্র দেশের বিভিন্ন কারখানায় আমদানি করা হয়, সেই সব যন্ত্রের বাক্স প্লাস্টিকের বেতি দিয়ে মোড়ানো থাকে। তিনিসহ তাঁর মতো ব্যবসায়ীরা ২০ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে ওই বেতি সংগ্রহ করে থাকেন, যা দিয়ে ধারা ও ডোল তৈরি করেন। তৈরির পর তাঁরা ১০০ টাকা কেজি দরে ধারা আর ১৩০ টাকা কেজি দরে ডোল বিক্রি করে থাকেন। 

ভীষ্মচন্দ্র মনিদাস আরও বলেন, গ্রামে ক্রমেই প্লাস্টিকের বেতির ডোল আর ধারার ব্যবহার বাড়ছে। চাহিদার কারণে ব্যবসারও প্রসার ঘটছে। ধামরাই উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় তাঁর মতো অনেকে এই ব্যবসা করে লাভবান হচ্ছেন বলে জানান তিনি।