লোকমান পদে থাকায় প্রশ্নের মুখে বিসিবি

লোকমান ভূঁইয়া
লোকমান ভূঁইয়া

কারাগারে থেকেও লোকমান হোসেন ভূঁইয়ার বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক পদে বহাল থাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে বিসিবি। ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির অভিযোগে সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত লোকমানের বিষয়ে বিসিবি কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

লোকমানকে গ্রেপ্তারের পর র‌্যাব জানিয়েছিল, তিনি অস্ট্রেলিয়ায় টাকা পাচার করেছেন। কিন্তু গতকাল রোববার পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা হয়নি। কেন হয়নি, সে সম্পর্কে পুলিশ বা র‌্যাব স্পষ্ট কিছু বলছে না। যদিও র‌্যাবের হাত ঘুরে লোকমান পুলিশ ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে তিন দফা রিমান্ড পার করেছেন। 

তবে লোকমানের বিরুদ্ধে ৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গতকাল মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। 

এ পরিস্থিতিতে পরিচালক পদে লোকমানকে কেন রাখা হয়েছে, সেই প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি তাঁকে সমর্থন দিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে বিসিবির সভাপতি নাজমুল হাসানের বিরুদ্ধে।

যে ক্রিকেট আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের জন্য গৌরব বয়ে আনছে, তার সঙ্গে অনৈতিক কাজে জড়িত কারও নাম থাকাটা অনাকাঙ্ক্ষিত বলে মনে করেন বিসিবির সাবেক সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী। তাঁর প্রশ্ন, র‌্যাবের হাতে আটক, মামলা ও গ্রেপ্তারের পর কীভাবে তিনি বিসিবির পরিচালক থাকেন? সাবের হোসেনের মতে, বিসিবি তাঁকে অন্তত কারণ দর্শানোর নোটিশ দিতে পারত। সাময়িকভাবে বরখাস্ত করার এখতিয়ারও বিসিবির আছে, রায় হওয়ার পর না হয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিত। তাই বলে গঠনতন্ত্রের কথা বলে এ রকম বিতর্কিত ব্যক্তিকে পরিচালনা পরিষদে রাখা ক্রিকেটেরই দুর্নাম।

মোহামেডান ক্লাবের ডিরেক্টর ইন-চার্জ লোকমানকে গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে তেজগাঁওয়ের মণিপুরিপাড়ার বাসা থেকে চার বোতল বিদেশি মদসহ গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। র‌্যাব-২-এর অধিনায়ক আশিক বিল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, লোকমান মোহামেডান ক্লাবের একটি অংশে ক্যাসিনো ভাড়া দিয়ে ৪১ কোটি টাকা আয় করেছেন। সেই টাকা অস্ট্রেলিয়ার ব্যাংকে জমা করেছেন। তাঁর ছেলে অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। তিনি প্রায়ই অস্ট্রেলিয়ায় যান এবং সেখানকার দুটি ব্যাংকে টাকা জমা রাখেন।

এই তথ্য প্রকাশের পরও র‌্যাব বাদী হয়ে লোকমান হোসেন ভূঁইয়ার নামে তেজগাঁও থানায় মামলা করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে। র‌্যাব কেন মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা করেনি, তা জানতে চেয়ে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক তোফায়েল মোস্তফা সারওয়ারের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে প্রথম আলো। কিন্তু তাঁকে পাওয়া যায়নি।

গত শুক্রবার তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শামীম অর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, লোকমানের বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) ভালো বলতে পারবে। ডিবির দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত করছেন। অর্থ পাচারের বিষয়টি তাঁদের তদন্তে আসেনি।

মোহামেডানের সাবেক অধিনায়ক ও ক্লাবের স্থায়ী সদস্য বাদল রায় গত শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘র‌্যাব সংবাদ সম্মেলন করে জানাল লোকমান টাকা পাচার করেছেন। অথচ মামলা হলো না—বিষয়টি আশ্চর্যজনক।’ তিনি আরও বলেন, মোহামেডান ক্লাব লিমিটেড পরিচালনার জন্য ২১২ জনের কমিটি আছে। ওই কমিটি ১৬ জনের পরিচালক নির্বাচন করে। তবে লোকমান হোসেন একা হাতে ক্লাব চালিয়েছেন। এমনকি টাকার বিনিময়ে তিনি অতিরিক্ত ১১২ জনকে সদস্যপদ দিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। 

ক্লাব-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শুভানুধ্যায়ীরা ক্লাবকে যে টাকা দিয়েছেন, তারও কোনো হিসাব-নিকাশ নেই। তিনি ক্যাসিনো পরিচালনার অনুমোদন দিয়েছেন একক সিদ্ধান্তে। এত কিছুর পরও টাকাপয়সা পাচারের বিষয়ে মামলা না হওয়াটা দুঃখজনক বলে মনে করেন বাদল রায়। 

 ১৯৯৪ সাল থেকে ফুটবলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন লোকমান। প্রথম ক্রিকেট বোর্ডে আসেন ২০১২ সালে। কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন কমিটির সভাপতি হন নাজমুল হাসান। ওই কমিটিতে নাজমুল অন্তর্ভুক্ত করেন লোকমানকে। পরে ২০১৩ সালের অক্টোবরে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লোকমানও বোর্ড পরিচালক হন। বিসিবির সর্বশেষ ২০১৭ সালের নির্বাচনেও তিনি পরিচালক হন। 

বিসিবির সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, পুরোনো বন্ধুত্বের সুবাদে বিসিবিতে নাজমুল হাসানের কাছের মানুষের একজন হয়ে ওঠেন লোকমান। নাজমুল হাসান তাঁকে পূর্বাচলে নির্মাণের অপেক্ষায় থাকা শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিতেও রেখেছেন।

সাবের হোসেন চৌধুরী মনে করেন, হয়তো বন্ধুত্বের প্রতিদান দিতেই লোকমানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘উনিই (নাজমুল) বলেছেন লোকমান তাঁর বন্ধু। তাঁর প্যানেল থেকে লোকমান বিসিবির পরিচালক হয়েছেন।’

বিএনপির চেয়ারপারসনের নিরাপত্তা কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা লোকমান হোসেন ভূঁইয়া কোনো এক সমাবেশে খালেদা জিয়ার মাথায় ছাতা ধরে আছেন—এমন একটি ছবি গ্রেপ্তারের পরপরই ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। 

এমন একজন ব্যক্তিকে পৃষ্ঠপোষকতা করার কারণ জানতে চাইলে নাজমুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ রকম কখনো হয়নি যে ক্রিকেট বোর্ডে মোহামেডানের কোনো প্রতিনিধি ছিল না। এর আগে তো মাহবুবুল আনাম মোহামেডান থেকে বোর্ডে ছিলেন, এটা নিয়ে তো কখনো আপত্তি হয়নি। মোহামেডান ক্লাব সারা জীবন বিএনপিই চালিয়েছে। ওখান থেকে বিএনপির লোক আসবে, নাকি আওয়ামী লীগের লোক আসবে?’

নাজমুল হাসান আরও বলেন, ‘মাহবুবুল আনামকে প্রথম বোর্ডে আনলেন তো সাবের হোসেন চৌধুরী। তখন কোনো সমস্যা হলো না। লোটাস কামাল সাহেবও তাঁর বোর্ডে মাহবুবুল আনামকে রাখলেন। কারও বেলায় কোনো সমস্যা হয়নি। আমার সময় আপত্তিটা কেন?’

এক প্রশ্নের জবাবে বিসিবির সভাপতি বলেন, ‘গঠনতন্ত্র অনুযায়ী মারা যাওয়া, পাগল হওয়া অথবা পদত্যাগ করা ছাড়া একজন কাউন্সিলরকেও আমরা বাদ দিতে পারি না। এই নিয়ম শুরু থেকেই আছে।’

 বিসিবির গঠনতন্ত্রের ২৫(খ) অনুচ্ছেদে আছে, ‘অভিযুক্ত সংস্থা বা ব্যক্তি আচরণবিধি ভঙ্গের দায়ে পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক এ উদ্দেশ্যে গঠিত কমিটি কর্তৃক এই অপরাধের জন্য আচরণবিধিতে উল্লেখিত শাস্তি পাবেন। তবে এ শাস্তি প্রদানের আগে সংশ্লিষ্ট অভিযুক্তকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে।’ অর্থাৎ, বিসিবির পরিচালনা পরিষদ তদন্ত কমিটি গঠন করেও অভিযুক্ত পরিচালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।

বিসিবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাইসউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে মুঠোফোনে বলেছেন, অসদাচরণ বা অনৈতিক কাজের দায়ে বিসিবি তাঁকে বহিষ্কার করতেই পারে। এ ক্ষেত্রে গঠনতন্ত্র বাধা হওয়ার কথা নয়। বর্ষীয়ান এই ক্রীড়া সংগঠক যোগ করেন, আইনেও আছে কেউ গ্রেপ্তার হলে তাঁকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করতে হবে। বিচারে দোষী প্রমাণ হলে তাঁকে বহিষ্কার করতে হবে এবং নির্দোষ প্রমাণিত হলে তিনি তাঁর দায়িত্বে ফিরে আসবেন।

এর আগে বিসিবির সভায় লোকমানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলা হলেও সেই সভা আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ প্রসঙ্গে নাজমুল হাসান বলেন, ‘আমরা আইনি পরামর্শ নিচ্ছি। বোর্ড সভা ডেকে আলোচনা করব। গঠনতন্ত্রে যেহেতু কিছু পাচ্ছি না, আমরা আইসিসির সঙ্গেও কথা বলব। যদি দোষী সাব্যস্ত হয়, তাকে আমরা রাখতে চাই না।’

তবে লোকমান হোসেন ভূঁইয়ার বিসিবিতে থাকার যৌক্তিকতা নেই বলে এর আগে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী কাদের বলেন, ‘আমার মনে হয় বোর্ড মিটিং যখন হবে, এ ব্যাপারে তাঁরা ব্যবস্থা নেবেন। আমি বিসিবির সভাপতির সঙ্গে আলাপ করব, যাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এখনো তাঁকে বোর্ডে রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই।’