সাগরযাত্রায় জেলেদের প্রস্তুতি

সাগরে শুঁটকি আহরণ মৌসুমের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন জেলেরা। বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার পেড়িখালী ইউনিয়নের পুটিমারী খালে।  ছবি: প্রথম আলো
সাগরে শুঁটকি আহরণ মৌসুমের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন জেলেরা। বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার পেড়িখালী ইউনিয়নের পুটিমারী খালে। ছবি: প্রথম আলো

১ নভেম্বর থেকে শুরু হচ্ছে সুন্দরবনে শুঁটকি আহরণ মৌসুম। সুন্দরবনের দুবলার চরের শুঁটকি পল্লিতে শুরু হবে কর্মব্যস্ততা। এ জন্য সমুদ্রগামী কয়েক হাজার জেলে নিচ্ছেন শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। 

এরই মধ্যে তাঁরা ট্রলার, নৌকা, জাল মেরামত সেরে নিচ্ছেন। এখন তাঁদের ব্যস্ততা সমুদ্রে ও সুন্দরবনের উপকূলে থাকতে প্রয়োজনীয় রসদ ক্রয় ও এর জন্য টাকা জোগাড়ে। অনেক জেলেই চড়া সুদে টাকা নিচ্ছেন সুদের কারবারিদের কাছ থেকে। কেউবা টাকা গ্রহণে এনজিও, বিভিন্ন ব্যাংক ও সমিতি থেকে ঋণ করছেন। এরপর আছে বনদস্যুদের হামলা, মুক্তিপণ ও অপহরণের শঙ্কা। ঋণ, সুদের বোঝার সঙ্গে এমন দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়েই ৫-৬ মাসের এক অনিশ্চিত জীবন শুরু করতে চলছে এসব জেলের প্রস্তুতি। 

শুঁটকি আহরণ মৌসুমে বঙ্গোপসাগরের কূলঘেঁষা আলোর কোল, মাঝের চর, দুবলার চর, মাঝের কেল্লা, নারকেলবাড়িয়া, শেলার চরসহ ৮টি চরে দেশের বিভিন্ন জেলার প্রায় ২০ হাজার জেলে অবস্থান করবেন। সমুদ্র থেকে মাছ আহরণ করে সুন্দরবনের চরে নিয়ে এসে শুঁটকি তৈরি করবেন তাঁরা। 

চলতি শুঁটকি আহরণ মৌসুমে রামপালের ১০টি ইউনিয়নের পাঁচ শতাধিক জেলে বহদ্দার তাঁদের ট্রলার ও জাল প্রস্তুত করেছেন। হিসাব অনুযায়ী, জেলার সব থেকে বেশি জেলে এই রামপালে। এর মধ্যে রামপাল সদর ইউনিয়নের কামরাঙ্গা, শ্রীফলতলা, ঝনঝনিয়া, ওড়াবুনিয়া; পেড়িখালী ইউনিয়নের সিকিরডাঙ্গা, পেড়িখালী, পুঁটিমারী, রোমজাইপুর ও বড়কাটালীর শতাধিক জেলে; বাঁশতলী ও বাইনতলা ইউনিয়ন থেকে মুজিবনগর, বাঁশতলী, গিলাতলা, কালিগঞ্জ, চাকশ্রী, শরাফপুর, কাশিপুর এবং দুর্গাপুর, রাজনগর, হুড়কা ও উজলকুড় ইউনিয়নের হুড়কা, কালেখারবেড় ও সোনাতুনিয়া থেকে পাঁচ শতাধিক জেলে সমুদ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। 

পেড়িখালীর ওমর ফারুক ও সোহেল মল্লিক প্রায় ১০ বছর ধরে শুঁটকি মৌসুমে সাগরে যান। এই সময় তাঁরা অস্থায়ীভাবে থাকেন দুবলার চরের আলোর কোলে। তাঁরা বলেন, ‘আমাদের কাহিনি কেউ শুনতে চান না। চড়া সুদে টাকা নিতে হয়। আছে ডাকাতের ভয়। নানা ঝড়–জলোচ্ছ্বাস তো আছেই।’ 

একই এলাকার আজাদ শেখ বলেন, মহাজনদের কাছ থেকে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ সুদে টাকা নেন অনেকে। শীত মৌসুমটা শুঁটকির সময়। অন্য সময় ফিরে আসতে হয়। দীর্ঘ বিরতির পর তাই নতুন করে সব ট্রলার, জালসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় মালামাল সংগ্রহ ও মেরামত করতে হয়। এর বাইরেও আছে নানা সমস্যা।

সরকার সুন্দরবনকে এরই মধ্যে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করেছে। তবে জেলেরা বলছেন, সাধারণ জেলের বেশে বনে ও সাগরে গিয়ে অনেকেই দস্যু বনে যান। আগের মতো দস্যুদের দৌরাত্ম্য না থাকলেও অনেক ধরনের চাপের মধ্যে থাকতেই হয়। সাগর ও বনে দস্যুতা কমেছে, কিন্তু এখনো আছে। আবার কাঙ্ক্ষিত মাছ আহরণ করতে পারলে পেশা ধরে রাখা সম্ভব হবে। 

সোনাতুনিয়া এলাকার জেলে আনোয়ার হোসেন বলেন, ঋণের চাপে থাকতে হয় সারা বছরই। যদি ভালো মাছ হয়, শুঁটকি হয়, তবেই বছরটা ভালোভাবে পার হয়। আর মৌসুমে যদি আবহাওয়া খারাপ হয়, তাহলে তো বেশি মাছ পাওয়া দূরে থাক, শুঁটকি নষ্ট হওয়ারই আশঙ্কা থাকে। আবার চরের মহাজনদের কাছ থেকে ভালো দামও মেলে না। 

সমুদ্রগামী জেলে সমিতির সভাপতি মল্লিক শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বিকল্প কোনো কাজের সুযোগ না থাকায় ধারদেনা করে হলেও শুঁটকি আহরণের এই অনিশ্চিত যাত্রায় ছুটতে হয় জেলেদের। শুঁটকি থেকে বড় অঙ্কের রাজস্ব পায় সরকার। তবে সব থেকে পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, বিভিন্ন চরে মহাজনদের কাছে মাছ বিক্রিতে আমরা সঠিক মূল্য পাই না।’ 

সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, প্রতিবছরের মতো এবারও বঙ্গোপসাগর–সংলগ্ন চরগুলোতে ১ নভেম্বর থেকে শুঁটকি আহরণ মৌসুম শুরু হচ্ছে। জেলেদের নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয়ে বনরক্ষকেরা সব সময় সহযোগিতা করে থাকেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। 

র‌্যাব-৬–এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ মোহাম্মদ নুরুস সালেহীন ইউসুফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুন্দরবনে দস্যুতা নির্মূল এবং জেলে-বাওয়ালি, মৌয়ালদের নিরাপত্তায় সারা বছরই র‌্যাবের তৎপরতা অব্যাহত থাকে। সুন্দরবনের দুবলার চরে আলোর কোলে আমাদের একটি ক্যাম্প রয়েছে। সেখান থেকে জেলেদের নিরাপত্তায় আমরা সর্বক্ষণিক কাজ করি। শুঁটকি মৌসুম সামনে রেখে সুন্দরবন ও উপকূলে আমাদের টহল জোরদার করা হয়েছে।’