দলীয় ঠিকাদারে ধুঁকছে চবির প্রকল্প

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জননেত্রী শেখ হাসিনা হলের দ্বিতীয় পর্যায়ের নির্মাণকাজের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছিল ২০১৬ সালের অক্টোবরে। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে এ কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে নির্ধারিত মেয়াদের এক বছর পরেও এ কাজের অগ্রগতি ৭০ শতাংশ। কাজটি করছেন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মঞ্জুরুল আলম চৌধুরী।

এ রকম আরও আটটি প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এর মধ্যে সাতটি প্রকল্পের কাজ করছে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ নেতার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এতে রয়েছে একাডেমিক ভবন, আবাসিক হল, প্রাধ্যক্ষ ও আবাসিক শিক্ষকদের ভবনের নির্মাণকাজ। এসব প্রকল্পে মোট ব্যয় হচ্ছে ২২৩ কোটি ৮১ লাখ টাকা। গড়ে এসব কাজের ভৌত অগ্রগতি ৪২ শতাংশ। আর আর্থিক অগ্রগতি গড়ে ৩৬ শতাংশ। তাই প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় বাড়ানো হলেও কাজ শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে।

‘অনিয়মের’ মাধ্যমে পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দেওয়া এবং প্রকৌশল দপ্তরের তদারকির অভাবে কাজগুলোর অগ্রগতি কম বলে বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে। আর নির্মাণকাজের ধীরগতির কারণে দুর্ভোগে রয়েছেন শিক্ষার্থীরা। নির্মাণকাজ দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য গত এক বছরে চার দফা আন্দোলনও করেন শিক্ষার্থীরা।

সরকারদলীয় ঠিকাদারের হাতে সাত কাজ

বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ ভবনের দ্বিতীয় পর্যায়ের নির্মাণকাজের মেয়াদ চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এখন পর্যন্ত কাজ হয়েছে মাত্র ৫৮ শতাংশ। বাকি দুই মাসে ৪২ শতাংশ কাজ করতে হবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দ্য বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ার্স-জিকেবিএলকে (জেভি)। ইতিমধ্যে ৩৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে এদের। জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠানের হয়ে বর্তমানে নির্মাণকাজটি তদারক করছেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবুল মনসুর জামশেদ।

জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠান জাল কাগজপত্র দিয়ে এ কাজ বাগিয়ে নেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান করে জাল কাগজপত্র থাকার প্রমাণও পেয়েছে।

অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান ছাত্র হলের দ্বিতীয় পর্যায়ের নির্মাণকাজও করছেন আওয়ামী লীগ নেতা মঞ্জুরুল আলম চৌধুরী। এই হলের কার্যাদেশ দেওয়া হয় গত বছরের মে মাসে। ৪ কোটি ৪১ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন হলটির কাজ মাত্র ৩০ শতাংশ শেষ হয়েছে।

জীববিজ্ঞান অনুষদের পঞ্চম একাডেমিক ভবনের নির্মাণকাজের মেয়াদ ছিল চলতি বছরের জুন পর্যন্ত। কিন্তু এক বছরে কাজ হয়েছে মাত্র ২৫ শতাংশ। ১৯ কোটি ৬৮ লাখ টাকার এ কাজের বিপরীতে ২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। কাজ শেষ করতে এখন আগামী বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছে। কাজটি করছেন মঞ্জুরুল আলম চৌধুরীর ভাই জাহেদুল আলম চৌধুরী। এটি ছাড়াও জাহেদুল আলম আরও দুটি কাজ করছেন। এগুলো হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ ও শিক্ষকদের জন্য কোয়ার্টার নির্মাণ ও ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজের জন্য একাডেমিক ভবন নির্মাণকাজ। এই দুটি কাজও নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি।

অন্যদিকে, ২০১৬ সালে ৭৫০ আসনের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের দ্বিতীয় পর্যায়ের নির্মাণকাজ দেওয়া হয় ঢালী কনস্ট্রাকশন লিমিটেডকে। ৬৭০ দিনের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা কার্যাদেশে উল্লেখ করা হয়। তবে বর্তমানে কাজটির ৪৭ শতাংশ শেষ হয়েছে। এ ছাড়া প্রকৌশলী দপ্তরের নতুন ভবনের নির্মাণকাজের ১৫ মাসে অগ্রগতি হয়েছে ২৮ শতাংশ। ভবনটি নির্মাণ করছে আওয়ামী লীগের উপকমিটির সাবেক সহসম্পাদক দিদারুল আলমের প্রতিষ্ঠান মেসার্স রয়েল অ্যাসোসিয়েটস। এ কাজের সঙ্গে আরও জড়িত আছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এম এ খালেদ চৌধুরী।

এসব ছাড়াও ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজের একাডেমিক ভবনের ৯ মাসে অগ্রগতি ৫ শতাংশ, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছাত্রী হলের দ্বিতীয় পর্যায়ের নির্মাণকাজ ২২ মাসে হয়েছে ৭৫ শতাংশ। এসব প্রকল্পের মেয়াদ ইতিমধ্যে শেষ হওয়ায় বাস্তবায়নের সময় বাড়ানো হয়েছে।

প্রকৌশলীরা ঠিকমতো উপস্থিত না থাকার কারণে এসব নির্মাণকাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ করা যায়নি বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগ নেতা মঞ্জুরুল আলম চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩টার পর আর প্রকৌশলী থাকেন না। প্রকৌশলী না থাকলে কাজ করা যায় না। এসব বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে।

ঠিকাদারদের গাফিলতিই কারণ

বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণকাজের অনিয়ম নিয়ে তদন্ত করছে দুদক। গত বছরের ২৮ অক্টোবর নির্মাণকাজের তথ্য চেয়ে প্রধান প্রকৌশলী মো. আবু সাঈদ হোসেনের কাছে চিঠি দেয় দুদক। ওই চিঠির মাধ্যমে আবু সাঈদ হোসেনের বিরুদ্ধে নির্মাণকাজের ক্ষেত্রে দুর্নীতি করে কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তদন্ত করতে নানা তথ্য চাওয়া হয়।

কোটি টাকা আত্মসাতের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান প্রকৌশলী মো. আবু সাঈদ হোসেন বলেন, দুদক তদন্ত করে যা পাবে, তাই হবে।

ঠিকাদারদের গাফিলতির কারণে নির্মাণকাজে অগ্রগতি নেই বলে জানান মো. আবু সাঈদ হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এসব বিষয়ে তাঁদের কয়েকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। এখন কাজ শেষ করতে না পারলে তাঁদের জরিমানা করা হবে, আবার দরপত্র দিয়ে নতুন কাউকে কাজ দেওয়া হবে। তাঁর দাবি, সব প্রক্রিয়া ঠিক রেখে সরকারি দলের ঠিকাদারদের কাজ দেওয়া হয়েছে।

দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা টিআইবির সাধারণ পর্ষদের সদস্য দেলোয়ার মজুমদার মনে করেন, অযোগ্য লোকেরা ঠিকাদার হয়ে গেলে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা যায় না। তাঁদের অনেক সময় জবাবদিহির জায়গায় যেতে হয় না। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঠিকাদার নিয়োগের সময় সতর্ক না থাকলে এমন সমস্যা হবেই।