আইনে মানা, তবু ১২১ শিশুর দণ্ড

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

শিশু আইনে স্পষ্টই বলা আছে, অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, অপরাধে জড়িত থাকা শিশুর বিচার শুধু শিশু আদালতেই হবে। অথচ ভ্রাম্যমাণ আদালত শিশুদের দণ্ড দিয়ে চলেছেন। এ মুহূর্তে টঙ্গীর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে ১২১টি শিশুর সন্ধান পাওয়া গেছে, যাদের দণ্ড দিয়েছেন র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এরা তিন মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত মেয়াদে কারাদণ্ড ভোগ করছে।

শিশু আইনের পাশাপাশি হাইকোর্টের একাধিক রায়েও বলা হয়েছে, শিশুর বিরুদ্ধে যেকোনো অভিযোগের বিচার শুধু শিশু আদালতেই হতে হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালত দূরের কথা, অধস্তন আদালতের কোনো বিচারক শিশুদের বিচার করলেও তা হবে বেআইনি।

২০০৭ সালে হাবিব মণ্ডল বনাম রাষ্ট্র মামলায় দেখা যায়, এক শিশু ধর্ষণ করে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। কিন্তু হাইকোর্ট তাকে বেকসুর খালাস দেন। কারণ, শিশুটির বিচার শিশু আদালতে হয়নি। ২০১৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর হাইকোর্ট একই ধরনের আরেকটি রায় দেন। ১৫ বছরের আবদুল জলিল একটি ধর্ষণ মামলায় ভোলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পায়। হাইকোর্ট বলেছেন, শিশু আইন বাদ দিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক ধরে নিয়ে ভুল আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তার সাজা হয়েছে। তাই তা বাতিল করা হলো। জলিল ১৪ বছর সাজাভোগ করেছিল। হাইকোর্ট ক্ষতিপূরণ বাবদ জলিলকে ৫০ লাখ টাকা দিতে রাষ্ট্রকে নির্দেশ দেন।

টঙ্গীর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ বছরের ৩ মে থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতে দণ্ডিত ১২১টি শিশু সেখানে রয়েছে। এদের মধ্যে ১৭ বছর বয়সী আছে ২৮ জন। ২৬ জনের বয়স ১৬, ২০ জনের বয়স ১৫, ১৬ জনের বয়স ১৪, ১১ জনের বয়স ১২। ৭ জনের বয়স ১৩। বাকি ১২ জনের বয়স ৮ থেকে ১১ বছর। একজনের বয়স উল্লেখ নেই। দণ্ডিতদের মধ্যে ৭৫ জনকে দণ্ডবিধির ৩৫৬ ধারা অনুযায়ী চুরির দায়ে ছয় মাস এবং ৩৪ জনকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী এক বছর করে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। শুধু একটি শিশু দণ্ডবিধির ১৮৯ ধারায় ছয় মাসের সাজা পেয়েছে। ১৩ বছর বয়সী শিশুটির বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১৮৯ ধারায় সাজা দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারীকে ক্ষতিসাধনের হুমকির অভিযোগ আনা হয়েছে।

৩৪টি শিশু ঠিক কী ধরনের মাদক অপরাধ করেছে, তার উল্লেখ নেই। তবে মাদক আইনের ৪২ ধারা উল্লেখ করে সাজা দেওয়া হয়েছে। এই ধারায় দুটি দফা আছে। প্রথম দফা বলছে, মাদক আইনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়নি, এমন ‘মাদকদ্রব্য অপরাধ’ করলে অনধিক এক বছর জেল দেওয়া যাবে। দ্বিতীয় দফা বলছে, মাদক অপরাধ দমনে নিয়োজিত আইন প্রয়োগকারী কাউকে বাধা দিলে কমপক্ষে দুই বছর ও অনধিক ১০ বছর দণ্ড পাবে।

এ ছাড়া যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রেও ভ্রাম্যমাণ আদালতে দণ্ডিত একটি শিশু আছে। কেশবপুরের এই শিশুটি বাল্যবিবাহের কারণে এক মাসের সাজা পেয়েছে বলে জানিয়েছেন ওই কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক মো. আবদুল্লাহ আল মাসুদ। কেন্দ্রটিতে ৩৩০টি শিশু রয়েছে।

জামিন বিষয়ে জানতে চাইলে টঙ্গী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের প্রবেশন কর্মকর্তা কে এম ওবায়দুল্লাহ আল মাসুদ গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ১২১টি শিশুর বেশির ভাগই (৯৯ জন) র‍্যাব সদর দপ্তরের ভ্রাম্যমাণ আদালতে দণ্ডিত। শিশুদের অভিভাবকেরা দীর্ঘদিন ঘোরাফেরা করেও জামিন করাতে পারছেন না। কারণ, র‍্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নথি পাঠায় না।

>টঙ্গীর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে ধারণক্ষমতা ৩০০ শিশু
গতকাল পর্যন্ত আছে ১০০১
ভ্রাম্যমাণ আদালতের দণ্ড পাওয়া শিশু গতকাল পর্যন্ত ১২১
যশোরে দণ্ডিত শিশু একজন।

ওবায়দুল্লাহ মাসুদ জানান, টঙ্গীতে ধারণক্ষমতার তিন গুণের বেশি শিশু অন্তরীণ আছে। ধারণক্ষমতা ৩০০, গতকাল বুধবার পর্যন্ত শিশু আছে ১ হাজার ১টি।

র‌্যাব সদর দপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলমের ৩০ জুলাই ও ২৪ আগস্ট সই করা দুটি, ২৬ আগস্ট র‌্যাব-৩ টিকাটুলীর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আক্তারুজ্জামানের সই করা একটি এবং ৯ আগস্ট র‌্যাব-৪ মিরপুর-১–এর আইন কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিজাম উদ্দিন আহমেদের সই করা চারটি আদেশে দেখা যায়, তাঁরা টঙ্গীর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রকে ‘কিশোর সংশোধন কেন্দ্র’ উল্লেখ করেছেন। লক্ষণীয় যে, তাঁরা যে ফরম পাঠিয়েছেন, তাতে ‘বাংলাদেশ ফরম নম্বর ৩৯৬৩ এবং হাইকোর্ট ফৌজদারি পরোয়ানা ফরম নম্বর ৩৭ উল্লেখ আছে। ২০১৭ সালের ১১ মে ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন হাইকোর্টে অসাংবিধানিক বলে চিহ্নিত হয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের আপিল বিচারাধীন রয়েছে।

যোগাযোগ করা হলে র‌্যাবের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, বিষয়টি ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম বলতে পারবেন। কিন্তু সারওয়ারের মুঠোফোনে গত মঙ্গলবার কল করে এবং খুদে বার্তা পাঠিয়েও তাঁর সাড়া পাওয়া যায়নি।

ফরমের বিষয়ে লিখিতভাবে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র সাইফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন বিচারাধীন থাকার কারণে এ বিষয়ে তাঁর কোনো মন্তব্য নেই।

আইন কী বলে
২০১৩ সালের শিশু আইন বলছে, ‘বিদ্যমান অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের উদ্দেশ্যপূরণকল্পে অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সকল ব্যক্তি শিশু হিসেবে গণ্য হবে।’ ১৬ ধারা বলছে, ‘আইনের সঙ্গে সংঘাতে আসা শিশু কর্তৃক সংঘটিত যেকোনো অপরাধের বিচার করবার জন্য প্রত্যেক জেলা সদরে এক বা একাধিক শিশু আদালত থাকবে। কোনো অপরাধ সংঘটনে প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশু একত্রে জড়িত থাকলেও শিশুর বিচার শুধু শিশু আদালতই করবে। শিশু আদালতেরও সাজসজ্জা ও ধরন ভিন্ন হতে হবে। অপরাধ অজামিনযোগ্য হোক বা না হোক, আদালত শিশুকে জামিনে মুক্তি দিতে পারবে। এমনকি আদালতে শিশুর প্রথম হাজির করবার ২১ দিনের মধ্যে প্রবেশন কর্মকর্তা একটি সামাজিক অনুসন্ধান দাখিল করবেন। প্রবেশন কর্মকর্তা বা বৈধ অভিভাবকসহ আইনজীবীর উপস্থিতি আদালতে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।’

ভ্রাম্যমাণ আদালতে শিশুদের বিচারের এখতিয়ারের বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আইনে যা আছে, সেটাই প্রাধান্য পাবে।

এ বিষয়ে আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের সচিব সারওয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন সংসদে পাস হয়েছে ২০০৯ সালে। আর শিশু আইনটি ২০১৩ সালে প্রণীত এবং ২০১৮ সালে সংশোধিত হয়েছে। তাই শিশু আইনের বিধানাবলিই প্রাধান্য পাবে।