রিফাত হত্যা মামলার প্রধান আসামির জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন, শুরু হয়নি বিচার কার্যক্রম

বরগুনায় আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় প্রধান আসামি রিফাত ফরাজী আদালতে দেওয়া তাঁর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন করেছেন। তাঁর পক্ষের আইনজীবী আজ বৃহস্পতিবার সকালে বরগুনার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম গাজীর আদালতে এই আবেদন করেন। মামলার অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার দুই মাস অতিবাহিত হলেও এখনো মামলাটির বিচারিক কার্যক্রম শুরু করা যায়নি।

আদালতে জবানবন্দি প্রত্যাহার চেয়ে করা আবেদনে উল্লেখ করা হয়, গ্রেপ্তারের পর পুলিশ তাঁকে নির্যাতন ও ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করেছে। 


রিফাত ফরাজী বরগুনা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি দেলোয়ার হোসেনের ভায়রার ছেলে। এই মামলায় রিফাত ফরাজীর ছোট ভাই রিশান ফরাজীও অন্যতম আসামি।

আদালতসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানায়, আজ আলোচিত এই মামলার শুনানির দিন ধার্য ছিল। এ জন্য সকাল সাড়ে ৯টায় রিফাত শরীফ হত্যা মামলার ২৪ আসামির মধ্যে ৮ জন প্রাপ্তবয়স্ক আসামিকে বরগুনা কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। জামিনে থাকা এই মামলায় প্রধান সাক্ষী থেকে আসামি হওয়া নিহত রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা ও আরিয়ান হোসেন আদালতে উপস্থিত হন। মামলার বাকি ১৩ অপ্রাপ্তবয়স্ক আসামি যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে থাকায় তাদের হাজির করা হয়নি।

সূত্র জানায়, বিচারক এই মামলার অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর আসামিদের বিচার কার্যক্রম শুরুর জন্য মামলার মূল নথি বরগুনার শিশু আদালতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে মামলার শুনানির পরবর্তী তারিখ ৬ নভেম্বর ধার্য করা হয়েছে। প্রধান আসামি রিফাত ফরাজীর জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদনটি তাঁর আইনজীবী আদালতে জমা দিলেও প্রাপ্তবয়স্ক আসামিদের মামলার মূল নথি জেলা জজ আদালতে থাকায় এর শুনানি হয়নি।

এর আগে রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকাসহ ২৪ জনকে আসামি করে ১ সেপ্টেম্বর এই মামলায় প্রাপ্ত ও অপ্রাপ্ত আসামিদের নিয়ে পৃথক দুটি অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেয় পুলিশ। অভিযোগপত্রে এই মামলার ১ নম্বর আসামি নয়ন বন্ড ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ায় তাঁকে এই মামলার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে ২ নম্বর আসামি রিফাত ফরাজীকে ১ নম্বর আসামি করা হয়।

রিফাত ফরাজীর আইনজীবী সিদ্দিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশ নির্যাতন করে এবং ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে রিফাত ফরাজীকে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করেছে। এ কারণে আমরা তাঁর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন করেছি।’ নয়ন বন্ডকে রিফাত ফরাজীর সামনেই ক্রসফায়ার দেওয়া হয় বলেও আবেদনে উল্লেখ করা হয় বলে জানান তিনি।

আলোচিত এই মামলার বিচার এখনো শুরু হয়নি। অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে প্রায় দুই মাস হলো। কিন্তু এখনো অভিযোগ গঠনের জন্য মামলাটি সংশ্লিষ্ট আদালতে যায়নি। এখনো জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতের জেনারেল রেজিস্ট্রার (জিআর) ফাইলেই রয়ে গেছে।

বাদীপক্ষের আইনজীবী মজিবুল হক বলেছেন, মামলার দুই আসামি পলাতক থাকায় মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হয়নি। নিয়মানুযায়ী পলাতক আসামিদের আদালতে হাজির হওয়ার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের জন্য আদালত নির্দেশ দিয়েছেন। এ অবস্থায় মামলাটি এখন জিআর ফাইলে রয়েছে।

এ বিষয়ে বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) ভূবন হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, পলাতক দুই আসামির বিষয়ে সম্প্রতি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে তাঁরা আদালতে হাজির না হলে তাঁদের অনুপস্থিতিতে বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হবে। এরপর মামলাটি বিচারের জন্য জেলা ও দায়রা জজ আদালতে যাবে। সেখানে অভিযোগ গঠন হবে এবং বিচার কার্যক্রম শুরু হবে। পিপি জানান, এই মামলায় প্রাপ্ত ও অপ্রাপ্ত উভয় আসামি আছে। প্রাপ্তবয়স্ক আসামিদের বিচারকার্য হবে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আর অপ্রাপ্তবয়স্ক আসামির বিচার হবে শিশু আদালতে।

গত ২৬ জুন সকালে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে রাস্তার ওপর রিফাত শরীফকে তাঁর স্ত্রী আয়শার সামনে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে একদল সন্ত্রাসী। হাসপাতালে নেওয়ার পর রিফাত মারা যান। তখন সন্ত্রাসীদের হাত থেকে স্বামীকে বাঁচাতে আয়শার আপ্রাণ চেষ্টার একটি ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এরপর সারা দেশে জানাজানি হয় বরগুনা শহরে সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ড নামের এক সন্ত্রাসীর নেতৃত্বে কিশোর ও তরুণদের নিয়ে গড়া বাহিনীর কথা। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কারও কারও পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা ওই বাহিনীর নানা অপকর্মের খবরও গণমাধ্যমে বের হতে থাকে। ঘটনার পাঁচ দিনের মাথায় পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন মামলার প্রধান আসামি নয়ন বন্ড।

পুলিশ এই মামলার তদন্ত শেষে ২৪ জনের বিরুদ্ধে ১ সেপ্টেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। আসামিদের মধ্যে ২ জন এখনো পলাতক, ২ জন জামিনে এবং বাকি ২০ জন গ্রেপ্তার আছেন। এই ২০ জনের মধ্যে ১২ জনের বয়স ১৮ বছরের নিচে। তাদের রাখা হয়েছে যশোর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে। প্রাপ্তবয়স্ক ৮ আসামি আছেন বরগুনা কারাগারে। পলাতক ও জামিনে থাকাদের মধ্যেও ২ জন কিশোর আছে।