কাউন্সিলর হয়েও সভায় তেমন যেতেন না, চাঁদাবাজি করতেন

অভিযান শেষে কাউন্সিলর ময়নুল হক মনজুকে ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড কার্যালয় থেকে নিয়ে যাচ্ছে র‍্যাব। গতকাল রাজধানীর টিকাটুলীতে।  প্রথম আলো
অভিযান শেষে কাউন্সিলর ময়নুল হক মনজুকে ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড কার্যালয় থেকে নিয়ে যাচ্ছে র‍্যাব। গতকাল রাজধানীর টিকাটুলীতে। প্রথম আলো

চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও দখলবাজির সঙ্গে জড়িত অভিযোগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ময়নুল হক ওরফে মনজুকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। তিনি টিকাটুলীর রাজধানী সুপার মার্কেটের ‘ত্রাস’ হিসেবে পরিচিত। এই মার্কেটের ব্যবসায়ীরা এর আগে কয়েকবার তাঁর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখলবাজির অভিযোগ করেছিলেন। এ নিয়ে চলমান শুদ্ধি অভিযানে ঢাকার তিন ওয়ার্ড কাউন্সিলর গ্রেপ্তার হলেন।

ময়নুল হক ওয়ারী থানা আওয়ামী লীগের ‘অনারারি সদস্য’। চাঁদাবাজি, দখলদারি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে তিনটি মামলা আছে তাঁর বিরুদ্ধে। গত বুধবার রাতে ওয়ারী থানায় সর্বশেষ মামলাটি করেছেন রাজধানী সুপার মার্কেটের ব্যবাসায়ী কাজী মো. রনি। মামলায় ময়নুল হক ও তাঁর ১২ অনুসারীকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় ময়নুলের বিরুদ্ধে ২ লাখ টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ আনা হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার গ্রেপ্তারের সময় তাঁর কাছ থেকে দুটি পিস্তল, কয়েক বোতল বিদেশি মদ, গাঁজা, ইয়াবা বড়ি, ফেনসিডিল ও যৌন উত্তেজক ওষুধসামগ্রী জব্দ করা হয়।

ময়নুল হক ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের দুবারের নির্বাচিত কাউন্সিলর। তিনি অবশ্য করপোরেশনের সভায় তেমন যেতেন না। ১৯টি বোর্ড সভার মধ্যে মাত্র চারটিতে উপস্থিত ছিলেন। ওয়ার্ডের সাধারণ নাগরিকদের সঙ্গে এই কাউন্সিলরের তেমন সম্পর্ক নেই। যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া তিনি সভায় অনুপস্থিত থাকায় ডিএসসিসি কারণ দর্শানোর নোটিশ দিলেও তিনি জবাব দেননি।

কাল র‌্যাবের অভিযানের সময় ময়নুলের কার্যালয়ের বাইরে কয়েক শ লোক জড়ো হন। তাঁরা মূলত রাজধানী সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী। তাঁরা কাউন্সিলের গ্রেপ্তার দাবিতে স্লোগান দেন। গ্রেপ্তারের ঘোষণা আসার পর ক্যামেরার সামনে উল্লাস প্রকাশ করেন এবং নিজেদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করেন তাঁরা।

র‌্যাব-৩-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল শাফি বুলবুল সাংবাদিকদের বলেন, ময়নুল হক দীর্ঘদিন ধরে চাঁদাবাজির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে উপার্জন করে আসছিলেন। এ ছাড়া তিনি মাদক সেবন এবং মাদক কেনাবেচার সঙ্গে যুক্ত। তাঁর অবৈধ কাজকর্ম এবং অর্থ উপার্জনের বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরে আসার পর গ্রেপ্তার করা হলো। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এখানে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, দখলবাজি করে আমেরিকায় পরিবারের কাছে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠান তিনি।

ময়নুলের বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ দীর্ঘদিনের
তিনি সিটি করপোরেশনের সভায়ও যেতেন না

ময়নুল দীর্ঘদিন ধরে চাঁদাবাজি করছেন। তাঁর কার্যালয় র‌্যাব-৩ কার্যালয় লাগোয়া। তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে এত সময় লাগল কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে শাফি বুলবুল বলেন, ‘তাঁকে তো শুধু গ্রেপ্তার করলেই হবে না। গ্রেপ্তার-পরবর্তী মামলা চালানোর মতো সাক্ষী-সাবুদ থাকতে হবে। এই প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর অভাবে যথোপযুক্ত সময়ে আমরা এটা করতে পারিনি। বাট দিস ইজ দা রাইট টাইম, মেচিউরড টাইম তাঁকে গ্রেপ্তার করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য।’

এই কার্যালয়ে অভিযানের পর র‌্যাব টিকাটুলীর হাটখোলা রোডের ‘গ্লোব নিবাসে’ ময়নুলের বাসায় অভিযান চালায়। চারতলা ভবনের তিন ও চারতলা মিলে তাঁর ডুপ্লেক্স বাসা। এই বাসায় তিনি ও তাঁর গাড়িচালক থাকতেন বলে জানিয়েছেন বাসার দারোয়ান মো. হাবিব। এই বাসা থেকে দেশীয় কেরু কোম্পানির ১২ বোতল মদ জব্দ করে র‌্যাব। আশপাশের লোকজন জানান, এই বাড়ি নিয়ে রাজউকের সঙ্গে গ্লোবের মামলা চলছে। ময়নুল সেই সুযোগে বাসাটি দখলে নিয়ে নেন।

কাউন্সিলর ময়নুলের বিরুদ্ধে অধিকাংশ অভিযোগই রাজধানী সুপার মার্কেটকেন্দ্রিক। এই মার্কেটের ১ হাজার ৮৮টি দোকান ঘিরেই ছিল তাঁর সবকিছু। এর আগেও মার্কেটের ব্যবসায়ীরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, র‌্যাবের মহাপরিচালক, র‌্যাব-৩ ও র‌্যাব-১০-এর অধিনায়কের কাছে এই কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে চাঁদাবাজি বন্ধ করার নির্দেশনাও আসে। কিন্তু কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নেতা-কর্মীরা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের এক সাবেক মন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যের ছত্রচ্ছায়ায় তিনি অবৈধ কাজ করতেন।

রাজধানী সুপার মার্কেটের হাজী গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কাউন্সিলর হওয়ার পর ময়নুল নিজেই মার্কেটের দখল নিয়ে নেন। তিনি নিজেকে সভাপতি হিসেবে ঘোষণা করেন। মার্কেটে দোকান নেওয়া বা ছেড়ে দেওয়া দুই কাজের জন্যই তাঁকে টাকা দিতে হতো। প্রতি মাসে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তিনি অতিরিক্ত এক হাজার টাকা নিতেন। মার্কেটে বিদ্যুৎ যায় না, তারপরও তাঁকে জেনারেটরের বিল দিতে হয়। কেন্দ্রীয় শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের জন্য প্রত্যেক দোকানদারের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা করে নিয়েছেন, কিন্তু কোনো কাজই করেননি।

ওয়ারী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আশিকুর রহমান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, থানার কমিটি করার জন্য তাঁরা যেসব নামের প্রস্তাব করেছিলেন, সেখানে ময়নুলের নাম ছিল না। পরে মহানগর থেকে যখন কমিটি চূড়ান্ত করে তাঁদের কাছে দেওয়া হয়, সেখানে দেখেন ময়নুলকে ‘অনারারি সদস্য’ রাখা হয়েছে।