তাঁত হারিয়ে যাচ্ছে, তবু বড় হচ্ছে তাঁতী লীগ

তাঁতশিল্প যখন বিলুপ্তির মুখে, তখন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন তাঁতী লীগের জন্ম। তবে তাঁতশিল্পের বিকাশে এই সংগঠনের কোনো ভূমিকা নেই। তাঁত হারিয়ে যাচ্ছে। কমছে তাঁতির সংখ্যা। বিপরীতে সারা দেশে বেড়ে চলেছে তাঁতী লীগের নেতা–কর্মী।

সংগঠনটির গঠনতন্ত্রে তাঁতশিল্পের উন্নয়নে অনেকগুলো লক্ষ্য বাস্তবায়নের কথা বলা আছে। বাস্তবে তাঁত বা তাঁতিদের স্বার্থে কোনো কর্মসূচি নেই। দিবসভিত্তিক রাজনৈতিক কর্মসূচি ও মূল দল আওয়ামী লীগের সভা–সমাবেশে যোগ দেওয়ার মধ্যেই সীমিত তাঁতী লীগের কার্যক্রম।

তাঁতিদের স্বার্থে তেমন কিছু না করলেও তাঁতী লীগে পদ–পদবি নিয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল দীর্ঘদিনের। এর জের ধরে মূল কেন্দ্রীয় কমিটির বাইরে গিয়ে গঠন করা হয়েছে ‘তাঁতী লীগ একাংশ’।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো গত বছর তাঁতশুমারি করে। গত ২৭ জুন তা প্রকাশিত হয়। তাতে দেখা যায়, ১৯৯০ সালে দেশে তাঁতি ছিলেন ১০ লাখ ২৭ হাজার ৪০৭ জন। ২০০৩ সালে এই সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৮ লাখ ৮৮ হাজার ১১৫ জনে। আর এখন তাঁত ইউনিটে কাজ করছেন ৩ লাখ ১৬ হাজার ৩১৫ জন।

২০০৩ সালের ২৯ মার্চ জন্ম নেয় তাঁতী লীগ। তখন থেকে এখন পর্যন্ত তাঁতি কমেছে ৫ লাখ ৭১ হাজার। গঠনতন্ত্রে বলা থাকলেও তাঁতশিল্পের বিকাশ বা আধুনিকায়নে কিছুই করেনি। তবে সংগঠনের বিকাশে সচেষ্ট রয়েছে তারা। সারা দেশে সংগঠনের কমিটি আছে। অবশ্য উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে তাঁতী লীগের কতটি কমিটি আছে, তার সুনির্দিষ্ট হিসাব সংগঠনের কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে পাওয়া যায়নি। সারা দেশে কত সদস্য আছেন, তারও সুনির্দিষ্ট হিসাব নেই। তবে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক খগেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁতী লীগের পরিধি আগের মতো ছোট নেই। ইউনিয়ন পর্যন্ত কমিটি করা হচ্ছে। এখন উপজেলাতেও কর্মসূচি দিলে দুই-তিন হাজার নেতা-কর্মী জমায়েত হন।

তাঁতী লীগের নেতারা বলছেন, ২০০৪ সালের ৮ আগস্ট থেকে ২৪ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে চলেছে দীর্ঘ এক যুগ। ২০১৭ সালে সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি হয়। এখন পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটি আছে। ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ৭০টিতে কমিটি গঠন করা হয়েছে। উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি করা হচ্ছে। দেশের যেসব জেলায় তাঁতশিল্প নেই, সেখানেও তাঁতী লীগের কমিটি আছে। এমনকি দেশের সীমানা পেরিয়ে যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুরেও কমিটি করেছে তাঁতী লীগ।

তাঁতী লীগের সভাপতি মো. শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, আগে কিছু জায়গায় নামমাত্র কমিটি ছিল। এখন তাঁরা ৮টি বিভাগীয় টিম গঠন করেছেন। বেশির ভাগ জেলায় আহ্বায়ক কমিটি দেওয়া হয়েছে। ১৪–১৫টি জেলায় কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা হয়েছে। উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সংগঠন দাঁড় করানো হচ্ছে। অনেকগুলো উপজেলা ও ইউনিয়নেও কমিটি গঠন করা হয়েছে।

>

৭০টি সাংগঠনিক জেলায় তাঁতী লীগের কমিটি আছে
উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়েও হচ্ছে
তবে তাঁতিদের স্বার্থে কোনো কর্মসূচি নেই

‘তাঁতী লীগ একাংশ’
২০১৭ সালে তাঁতী লীগের সম্মেলনের পর কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা হয়। কমিটিতে কাঙ্ক্ষিত পদ না পেয়ে একটি অংশ ওই বছরের ৩০ জুন ‘তাঁতী লীগ একাংশ’ নামে আলাদা কমিটি ঘোষণা করে। সে কমিটি এখনো সক্রিয়। এই অংশের প্রস্তাবক ও প্রধান সমন্বয়কারী তুষার আহাম্মেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কেন্দ্রীয় কমিটির বাইরে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণে এবং ঢাকার বাইরে ১৭টি জেলায় তাঁদের কমিটি সক্রিয়। তাঁদের অংশই মূলত জাতীয় কর্মসূচি পালন করে এবং তাঁরাই এগিয়ে আছেন বলে তিনি দাবি করেন।

এই অংশটি নিয়ে মূল কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। গত ১৪ অক্টোবর তাঁতী লীগ এক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছে, ‘তাঁতী লীগ একাংশ’ নাম ব্যবহার করে জনমনে বিভ্রান্তি ও অসাংগঠনিক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এটা গুরুতর অপরাধ।

তাঁত নেই, কমিটি আছে
তাঁতশুমারি বলছে, ভোলা, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর ও সাতক্ষীরা জেলায় কোনো তাঁত কারখানা নেই। কিন্তু এসব জেলায় তাঁতী লীগ সক্রিয়। ২০১৭ সালে ভোলায় তাঁতী লীগের ৩১ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি হয়। এরপর ৭টি উপজেলায় প্রতিটিতে ৩১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি করা হয়েছে। কয়েকটি ইউনিয়ন ও পৌরসভায়ও আহ্বায়ক কমিটি আছে। ভোলা জেলায় তাঁতি না থাকলেও আড়াই শর বেশি পদধারী তাঁতী লীগের নেতা আছেন।

সংগঠনের ভোলা জেলা শাখার আহ্বায়ক এনামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, অন্য সহযোগী সংগঠনগুলোর মতো তাঁতী লীগও মূল দলের সঙ্গে থেকে দলকে সহযোগিতা করছে। এ ছাড়া ভোলায় তাঁতশিল্পকে জাগ্রত করার জন্য তাঁরা গ্রামে গ্রামে তাঁতি খুঁজে বেড়াচ্ছেন।

যেসব জায়গায় তাঁত নেই, সেখানে তাঁতী লীগের কী কাজ, এমন প্রশ্নে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে সংগঠনের শীর্ষ দুই নেতার কাছ থেকে। কেন্দ্রীয় সভাপতি শওকত আলী বলেন, তাঁরা রাজনীতি করেন, ভোটের বিষয় আছে। এ কারণে সব জেলায় কমিটি করা হয়। না হলে সংগঠন দুর্বল হয়ে থাকে।
আর সাধারণ সম্পাদক খগেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথ বলেন, যেখানে তাঁতপণ্য উৎপাদিত হচ্ছে, সেগুলো যাতে অন্য সব জায়গায় বাজারজাত করার কাজে সহায়তা করা যায়, এ জন্য সব জায়গায় কমিটি দেওয়া হচ্ছে।

গত ১৫ বছরে কোথায় কোথায় তাঁতপণ্য বাজারজাতকরণে তাঁতী লীগ সহায়তা করেছে, এমন প্রশ্নে খগেন্দ্র দেবনাথ বলেন, তাঁরা এখন এই বিষয়ে পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছেন।

গঠনতন্ত্রেই সীমাবদ্ধ লক্ষ্য–উদ্দেশ্য
গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, মোটাদাগে তাঁতী লীগের উদ্দেশ্য তিনটি—১. হতদরিদ্র তাঁতিসমাজসহ পশ্চাৎপদ সব শ্রেণি–পেশার মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি সুশৃঙ্খল সংগঠন গড়ে তোলা; ২. তাঁতশিল্প সম্প্রদায় ও বস্ত্র খাতের উন্নয়নের সমস্যা ও অন্তরায়গুলো চিহ্নিত করে বাস্তবসম্মত সমাধানের লক্ষ্যে বিজ্ঞানভিত্তিক প্রযুক্তিনির্ভর কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন; ৩. আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ ঘোষিত সব কর্মসূচি, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কাজ করা।

তাঁতমালিক, শ্রমিক ও তাঁতিসমাজের স্বার্থরক্ষায় আগ্রহী ব্যক্তিদের সংগঠিত করা তাঁতী লীগের অন্যতম লক্ষ্য। এ ছাড়া গঠনতন্ত্রে আরও ৭টি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলা আছে। সেগুলো হলো, তাঁতি পরিবারকে স্বনির্ভর করতে সচেতন করা এবং তাঁতশিল্পকে লাভজনক খাতে রূপান্তরে যুগোপযোগী কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদিত তাঁতবস্ত্রের গুণগত মান বৃদ্ধি করে প্রতিযোগিতা বাজারে টিকিয়ে রাখা। তাঁতবস্ত্রের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করে দেশের ভেতরে ও বহির্বিশ্বে বাজার সৃষ্টি। রপ্তানিনির্ভর জাতীয় বস্ত্রনীতি প্রণয়নে সরকারকে প্রভাবিত করা। তাঁত ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাঁতীয়দের সহজ শর্তে ঋণ ও সরকারি প্রণোদনার ব্যবস্থা করা। জাতীয় তাঁত বোর্ড ও তুলা চাষ উৎপাদন সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে তাঁতী লীগের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত এবং তাঁতিদের মৌলিক অধিকারগুলো প্রাপ্তির লক্ষ্যে কাজ করা।

এসব লক্ষ্যের কথা গঠনতন্ত্রেই সীমাবদ্ধ। এ জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে বা মাঠপর্যায়ে কোথাও কোনো কর্মসূচি নেই। টাঙ্গাইল জেলা তাঁতী লীগের আহ্বায়ক আক্কাস আলী তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের কাজ মূলত জেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া।

সাত দফা লক্ষ্য–উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তাঁতী লীগ কী করেছে, তার কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। খগেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথ দাবি করেন, তাঁরা সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করা, তাঁতিদের সমস্যা দেখার চেষ্টা করেন। বস্ত্র ও পাটমন্ত্রীকে নিয়ে বিভিন্ন সময় সেমিনার ও সভা করেছেন, দুই বছরে চারটি কর্মশালা করেছেন। এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন নীতি ও গাইডলাইনে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন বলে দাবি করেন সংগঠনের সভাপতি শওকত আলী।

গঠনতন্ত্র ও নেতাদের বক্তব্যে তাঁতিদের জন্য অনেক কিছু করার কথা প্রচার থাকলেও বাস্তবতা সম্পূর্ণ বিপরীত। মূলত মূল দলের সহযোগী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাঁরা একটি পরিচয় পান। দল ক্ষমতায় থাকলে এই পরিচয়ে কিছু সুযোগ–সুবিধা পেয়ে থাকেন। পেশাজীবী সংগঠন হলেও পেশাজীবীদের স্বার্থে কখনো কিছু করেন না। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার তাঁতসমৃদ্ধ এলাকা ছাতিহাটী গ্রাম এবং দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল গ্রামের বেশ কয়েকজন তাঁতির সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁরা বলেন, তাঁতি বা তাঁতশিল্প নিয়ে তাঁতী লীগের কোনো কর্মসূচি বা কর্মকাণ্ড তাঁদের চোখে পড়েনি।

(প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর ভোলা, টাঙ্গাইল ও নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি)