হারিয়ে যাওয়া সেই পটের গান

পটের গান শোনাচ্ছেন শিক্ষক; শুনছে শিক্ষার্থীরা। সম্প্রতি  মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের চন্দ্রনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।  ছবি: প্রথম আলো
পটের গান শোনাচ্ছেন শিক্ষক; শুনছে শিক্ষার্থীরা। সম্প্রতি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের চন্দ্রনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ছবি: প্রথম আলো

‘শোনো গ্রামবাসী...সকলরে দয়াল গাজীর কিচ্ছা যাই বলে, শোনো প্রাণ খুলে।’ কাপড়ের ওপরে আঁকা নানা ধরনের ছবি। লাঠি দিয়ে একটির পর একটি ছবি দেখাচ্ছেন শিল্পী। সঙ্গে সঙ্গে ওই ছবির কাহিনি এভাবে গানের সুরে সুরে তুলে ধরছেন।

ছবি দেখিয়ে গান গাওয়া হয় বলে নাম পটের গান। একটা সময় গ্রামবাংলায় ছিল তুমুল জনপ্রিয়। নীতি-নৈতিকতা ও ধর্মীয় কাহিনি শেখার বড় ভরসা ছিল লোকসংস্কৃতির এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কালের বিবর্তনে আজ এই পটের গান হারিয়ে গেছে। তবে ভিন্ন আঙ্গিকে এই গান বাঁচিয়ে রাখার অনন্য উদ্যোগ নিয়েছে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের একটি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

চন্দ্রনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হারানো এই উদ্যোগ নিয়েছে। বিদ্যালয়ে ডিজিটাল ব্যানারে ছাপানো হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী নিয়ে ধারাবাহিক ছবি। তা নিয়ে টিফিনের ফাঁকে কিংবা কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন হলেই শিক্ষকেরা হাজির হন। পট দেয়ালে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। একে একে সংশ্লিষ্ট ছবির কাহিনি গানের মাধ্যমে তুলে ধরেন শিক্ষকেরা। উপস্থিত শিক্ষার্থীরা এই পটের গান শুনে বঙ্গবন্ধুকে জেনে নেয়। অনেক সময় শিক্ষার্থীদের দিয়েও গান গাওয়ানো হয়।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জহর তরফদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘একসময় আমরা দেখতাম এই পটের গানের মাধ্যমে ধর্মীয় কাহিনি, রাজা–বাদশাহদের জীবনী তুলে ধরা হতো। আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখন এই পটের গানের শিল্পীদের কদর নেই। অর্থ উপার্জন তেমন না হওয়ায় তাঁরা এই গান ছেড়ে দিয়েছেন। বর্তমানে পটের গান হারিয়ে গেছে। এ অবস্থায় আমরা হারানো এই ঐতিহ্য সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছি।’

বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, হারিয়ে যাওয়া পটের গান সংরক্ষণ ছাড়াও এই উদ্যোগের পেছনে তাদের কয়েকটি উদ্দেশ্য রয়েছে। তরুণ প্রজন্মের কেউ এখন পটের গান কী জানেই না। এই গান সম্পর্কে তারা ধারণা দিতে পারছে। তা ছাড়া এই বিদ্যালয়ে যে পটের গান সাজানো হয়েছে, তার উপজীব্য বঙ্গবন্ধুর জীবনী। এতে শিক্ষার্থীরা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে পারছে। এটা তাদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগাতে সাহায্য করছে।

পুরোনো দিনে যাঁরা পটের গান গাইতেন, তাঁদের এটা পেশা ছিল। গান শুনে গ্রামবাসী খুশি হয়ে শিল্পীদের টাকাপয়সা, ধান-চাল দিয়ে সাহায্য করতেন। এর মাধ্যমে উপার্জন করে সংসার চালাতেন শিল্পীরা। ওদিকে গ্রামবাসীরও উপকার হতো। কারণ, শিল্পীরা ছবি দেখিয়ে গানের মাধ্যমে গাজী কালু, রামায়ণ, ধর্মীয় কাহিনি, রাজা–বাদশাহদের জীবনী তুলে ধরতেন। এসব গানে থাকত বিভিন্ন ধর্মীয় মূল্যবোধ, নৈতিক শিক্ষা ও সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করার উপাদান।

কখনো একজন শিল্পী একাই কাজটা করতেন। খালি গলায় গান গেয়ে চলতেন। কখনোবা দু-একজন সঙ্গী নিয়ে আসতেন। তাঁরা দেশীয় বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে সুর তুলতেন। সাধারণত, একেকটি পটের গানের কাহিনিতে দশের বেশি ছবি থাকত। নতুন প্রজন্ম এসব সম্পর্কে কিছুই জানে না। এ অবস্থায় চন্দ্রনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই উদ্যোগ হারিয়ে যাওয়া পটের গান সংরক্ষণে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন অনেকে।

শ্রীমঙ্গলের নাগরদোলা থিয়েটারের সভাপতি অনিরুদ্ধ সেনগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছোটবেলায় আমরা শ্রীমঙ্গলে প্রায় গ্রামেই পটশিল্পীদের দেখেছি। এখন কেউ আর পট নিয়ে এসে গান শোনান না। চন্দ্রনাথ স্কুল যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা প্রশংসার দাবি রাখে। আমরা আশা করব স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের এই উদ্যোগ পটের গান এই প্রজন্মের মধ্যে আবার জনপ্রিয় করে তুলবে। হারানো সেই ঐতিহ্য ফিরে আসবে।’