চা বিক্রি করে স্থাপন করা খালেকের বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্ত হলো

কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার নলুয়া চাঁদপুর উচ্চ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন চা বিক্রেতা আবদুল খালেক। ছবিটি গত বৃহস্পতিবার সকালে তোলা। ছবি: প্রথম আলো
কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার নলুয়া চাঁদপুর উচ্চ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন চা বিক্রেতা আবদুল খালেক। ছবিটি গত বৃহস্পতিবার সকালে তোলা। ছবি: প্রথম আলো

ষাটের দশকে চা বিক্রি করে ৭ হাজার টাকা জমিয়ে ৫২ শতক জমি কেনেন আবদুল খালেক। এরপর ওই জমি বিদ্যালয়ের জন্য দান করেন। গত সপ্তাহে তাঁর স্বপ্নের বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্ত হয়। এ খবর পেয়ে খালেক (৯১) আনন্দে আত্মহারা।

কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার নলুয়া চাঁদপুর গ্রামে ওই বিদ্যালয়ের অবস্থান। বিদ্যালয়ের নাম নলুয়া চাঁদপুর উচ্চবিদ্যালয়।

বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৭ সালের ১ জানুয়ারি নলুয়া চাঁদপুর উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে ছয়জন শিক্ষক ও কর্মচারী দুজন রয়েছেন। এর বাইরে খণ্ডকালীন শিক্ষক আছেন চারজন। শিক্ষার্থী আছে ৪৩৭ জন। বিদ্যালয়ে বর্তমানে জায়গার পরিমাণ ৯৩ দশমিক ৫০ শতক। বিদ্যালয়ের টিনশেডের ঘরটি জরাজীর্ণ। তবে নতুন করে একটি চারতলা ও একটি একতলা ভবন হবে বলে শিক্ষকেরা জানিয়েছেন।

গত বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিনে দেখা গেছে, আবদুল খালেক লাঠিতে ভর করে শিক্ষক মিলনায়তনে আসছেন। তাঁর পেছনে একদল খুদে শিক্ষার্থী। শিক্ষকেরা তাঁকে এগিয়ে আনেন।

এমপিওভুক্তির প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে আবদুল খালেক বলেন, ‘এই এলাকা শিক্ষাদীক্ষায় মেঘাচ্ছন্ন ছিল। আমি শিক্ষার আলো ছড়াতে জমি দিয়েছি। কেবল আমি নই, পুরো এলাকাবাসী এমপিওভুক্তিতে খুশি। আমি এই এলাকার ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো পৌঁছাতে পেরেছি। এটাই আমার সার্থকতা।’

বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার গল্প শোনান আবদুল খালেক। তিনি বলেন, ‘এই গ্রামের অধিকাংশ মানুষ অশিক্ষায় নিমজ্জিত। মানুষের মধ্যে কিছুটা কুসংস্কারও রয়েছে। এর মধ্যেও এলাকার হাতে গোনা কয়েকজন শিক্ষিত তরুণ বিএ পাস করেছে। গ্রামের মানুষজন ওদের নাম বিকৃত করে উচ্চারণ করত। বিষয়টি আমার মতো একজন নগণ্য চা–দোকানদারের মনে দাগ কাটে। চা বানাতে গিয়ে একদিন প্রতিজ্ঞা করলাম, গ্রামের মানুষদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে। তাদের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে হবে। এই ভাবনা থেকেই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিই। তাই তো, নিজের কেনা ৫২ শতক জমি বিলিয়ে দিই প্রতিষ্ঠানের জন্য। এখন আমার ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শত শত শিক্ষার্থী। প্রতিদিন বিদ্যালয়ের সামনে বসে চা বানাই, আর শিক্ষার্থীদের হই–হুল্লোড় দেখি। এসব দেখে পরান জুড়িয়ে যায়। মনে শান্তি পাই। মাঝেমধ্যে শিক্ষার্থীরা আমার সঙ্গে দুষ্টুমি করে। আমার স্ত্রী, সন্তান না থাকায় ওদেরই আমার সন্তান এবং নাতি-নাতনির মতো মনে হয়।’

আবদুল খালেক আরও বলেন, ‘আমার স্বপ্ন ছিল বিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ফল দেখে যাওয়া। সেটি দেখেছি। এখন চাই একদিন এখানে কলেজ হবে।’

নলুয়া চাঁদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ফখরুদ্দিন বলেন, ‘তিনি (আবদুল খালেক) আমার বাবার সহপাঠী ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি তিনি শুদ্ধ বাংলায় কথা বলেন। তাঁর অবদান এলাকাবাসী সারা জীবন মনে রাখবে।’

নলুয়া চাঁদপুর গ্রামের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম বলেন, আবদুল খালেক সরলমনা ও উদার মানসিকতার লোক।

জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আবদুল মজিদ বলেন, আবদুল খালেকের ত্যাগ এলাকাবাসী মনে রাখবে। তাঁর মতো শিক্ষাবান্ধব লোক প্রতি এলাকায় থাকা দরকার।

২০১১ সালে আবদুল খালেককে নিয়ে প্রথম আলোতে শনিবারের বিশেষ প্রতিবেদন ও ২০১২ সালে প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে একটি নিবন্ধ ছাপা হয়।