বিস্তৃত হচ্ছে তাঁতী দলও

তাঁতশিল্প যখন সংকুচিত ও বিলুপ্তির পথে, তখন সারা দেশে বিস্তৃত হচ্ছে জাতীয়তাবাদী তাঁতী দল। ইতিমধ্যে ৪৬ জেলায় তাদের কমিটি হয়েছে। সব জেলা ও মহানগরকে ৮২টি সাংগঠনিক ইউনিটে ভাগ করে কমিটি গঠনে নেমেছে তাঁতী দল।

খোঁজখবর নিয়ে দেখা গেছে, ১৯৯১ ও ২০০১ সালে বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন তাঁতশিল্পের প্রসারে উল্লেখযোগ্য কোনো অবদান রাখতে পারেনি বিএনপি সরকার। বিএনপির দুই শাসনামলেই তাঁতির সংখ্যা কমেছে।

তাঁতী দলের কমিটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, যাঁরা মূল দল বিএনপি বা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসংগঠনে জায়গা পান না, তাঁদের পদ-পদবি দেওয়ার কৌশল থেকেই তাঁতী দলের কমিটি গঠন। সর্বশেষ গত ৬ এপ্রিল ১২৮ সদস্যের তাঁতী দলের আহ্বায়ক কমিটি দেয় বিএনপি

সংগঠনটির তথ্যমতে, দেশের ১৪টি জেলায় তাদের কমিটি ছিল। গত এপ্রিলে আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পর ৪৬ জেলায় তাঁতী দলের কমিটি হয়েছে। বাকি জেলা ও মহানগরগুলোতেও কমিটি গঠন প্রক্রিয়াধীন আছে। সর্বনিম্ন ২১ সদস্য থেকে ৫১ সদস্যের মধ্যে কমিটি করা হচ্ছে। কমিটির গঠন স্বচ্ছভাবে হচ্ছে কি না, তা সরেজমিনে দেখছে ১৫ সদস্যের আরেকটি কমিটি।

দেশের তাঁতবহুল জেলাগুলো হচ্ছে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নওগাঁ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, বরগুনা, পটুয়াখালী, কক্সবাজার ও রাঙামাটি। এসব জেলায় তাঁতী দলের কমিটি ছিল, এখনো আছে। তবে দেশের চারটি জেলা লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, সাতক্ষীরা ও ভোলায় কোনো তাঁত নেই। এর মধ্যে ভোলায় কমিটি নেই, চাঁদপুরের কমিটি বাতিল করা হয়েছে। বর্তমানে লক্ষ্মীপুর ও সাতক্ষীরায় শক্তিশালী কমিটি আছে বলে জানান তাঁতী দলের আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক জেলায় তাঁত নেই। যেখানে তাঁত আছে, সেখানে আমরা তাঁতশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্তদের নিয়ে কমিটি দিচ্ছি। আর যেখানে তাঁত নেই, সেখানে ছাত্রদল, যুবদল, বা স্বেচ্ছাসেবক দলে যাঁদের জায়গা হয়নি, তাঁদের সুযোগ করে দিচ্ছি।’

এর আগে প্রায় ৩৩ বছর ধরে তাঁতী দলের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি ছিলেন হুমায়ুন ইসলাম খান। এখন তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির তাঁতীবিষয়ক সম্পাদক। তিনি জানালেন, যাঁরা মূল দলে (বিএনপি) জায়গা পাননি, মূলত তাঁদের প্রতিভার বিকাশের একটা সুযোগ করে দেওয়া হয় তাঁতী দলে পদ দিয়ে।

গঠনতন্ত্র, দপ্তর—কিছুই নেই

তাঁতী দলের প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৮০ সালে। এরপর ৩৯ বছরেও সংগঠনের গঠনতন্ত্র তৈরি করতে পারেননি নেতারা। এমনকি সংগঠনের কোনো কার্যালয় বা দপ্তর নেই। নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়কে তাঁতী দল ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করে। কিন্তু সেখানে তাদের জন্য কোনো কক্ষ নেই। দাপ্তরিক কাজের জন্য চেয়ার-টেবিলও নেই। কার্যালয়ের তৃতীয় তলার একটি কক্ষে সংগঠনের একটি ক্যাবিনেট ​ছিল, সম্প্রতি সেটিও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

অবশ্য তাঁতী দলের আহ্বায়ক দাবি করেন, ২০১৬ সালে তাঁতী দলের গঠনতন্ত্রের একটি খসড়া তৈরি করে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দেওয়া হয়েছে। সেটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। সেই খসড়া গঠনতন্ত্র অনুসারে সংগঠন পরিচালিত হচ্ছে। তবে খসড়া গঠনতন্ত্রটি তাঁর কাছে নেই বলে জানান।

নেতা হতে তাঁতি হন

তাঁতী দলের আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ ১৬ বছর ধরে সংগঠন করেন। ২০০৪ সালে তিনি তাঁতী দলের সহসভাপতি হন। পরে হুমায়ুন ইসলাম খান তাঁতী দলের সভাপতি হলে সে কমিটির সাধারণ সম্পাদক হন আবুল কালাম। এরপর তিনি আহ্বায়ক ও মজিবুর রহমান মোল্লা সদস্যসচিবের দায়িত্ব পান। আবুল কালামের বাড়ি চাঁদপুরে, সেখানে কোনো তাঁতশিল্প নেই। মজিবুর রহমান মোল্লার বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে। সেখানে একসময় তাঁর তাঁত ছিল, এখন আর নেই।

আবুল কালাম আজাদ বলেন, তাঁতী দলের আহ্বায়কের দায়িত্ব পাওয়ার আগে তিনি সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থেকে পাঁচটি তাঁত কিনে মানিকগঞ্জে বসান। তাতে গামছা তৈরি করতেন। এখন বন্ধ। তাঁর দাবি, তাঁর তাঁতগুলো স্থানীয় তাঁতী লীগ বন্ধ করে দিয়েছে।

দাবি তাঁত ব্যাংক

তাঁতি ও তাঁতশিল্পের উন্নয়নে তাঁতী দলের ১১ দফা দাবি আছে। এর মধ্যে সুতা, রংসহ তাঁত উপকরণের দাম ক্রয়সীমার মধ্যে রাখা, রেশনিং পদ্ধতিতে সুতা পাওয়া, প্রান্তিক তাঁতিদের পুনর্বাসন করা উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে তাদের অন্যতম দাবি হচ্ছে তাঁত ব্যাংক প্রতিষ্ঠা। বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে তাঁতী দল এ দাবি আদায় করবে। সংগঠনের আহ্বায়ক বলেন, কৃষকের জন্য কৃষি ব্যাংক এবং বেকারদের জন্য কর্মসংস্থান ব্যাংক থাকতে পারলে তাঁতিদের জন্য একটা তাঁত ব্যাংক থাকবে না কেন?

তাঁতী দলে অনাগ্রহ

জানা গেছে, ঘটা করে সারা দেশে তাঁতী দলের কমিটি করা হলেও সংগঠনের দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম নেই। এমনকি গত ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবরে শ্রদ্ধা জানানোর অনুষ্ঠানে তাঁতী দলের কোনো ব্যানার ছিল না। পরদিন বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শোভাযাত্রায় মাত্র ১৮ জন নেতা উপস্থিত ছিলেন। তাঁতী দলের প্রতি নেতা-কর্মীদের কোনো আগ্রহ নেই। সংগঠনে তাঁতিদেরও খুব একটা সম্পৃক্ততা নেই। মূলত বিএনপিতে জায়গা না পাওয়া ব্যক্তিরাই সংগঠনে যুক্ত হন।

এরপরও তাঁতী দলের সদস্যসচিব মজিবুর রহমান মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে সংগঠনের অবস্থা খুব ভালো। আমরা সারা দেশে কমিটি করছি।’

তাঁতী দলের সাবেক নেতারা বলছেন, নেতা-কর্মীদের প্রথম পছন্দ মূল দল বিএনপি। এরপর যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল। তা না হলে শ্রমিক দল ও কৃষক দল। এ অবস্থায় প্রকৃত তাঁতী না পাওয়ায় মূল দল বিএনপির সহযোগিতায় তাদের কমিটি করতে হয়। ফলে বেশির ভাগ সময় জেলা বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের সুপারিশে তাঁদের পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি করতে হয়।

বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির তাঁতিবিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুধু এক পেশার লোক দিয়ে সংগঠন চলবে না। তাঁতিদের সংগঠিত করার জন্যও সংগঠক লাগে। তা ছাড়া, আমরা কেউ হয়তো বস্ত্র তৈরি করি, কেউ বিক্রি করি; কিন্তু সবাই বস্ত্র পরিধান করি। সে হিসেবে আমরা সবাই তাঁতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সেভাবেই আমরা কমিটি করি।’