অসুস্থ ছেলেটিকে মা-ই হত্যা করেছেন: পুলিশ

আড়াই বছরের রাফি। ছবি: সংগৃহীত
আড়াই বছরের রাফি। ছবি: সংগৃহীত

অসুস্থ রাফির চিকিৎসার ব্যয় মেটানো ও ধার করা টাকা পরিশোধে ব্যর্থতায় মানসিক হতাশা থেকে মা-ই তাকে হত্যা করেছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। আজ শনিবার দুপুর ১২টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আনিসুর রহমান নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে শিশু রাফি হত্যার বিষয়ে এ তথ্য জানান।

গত বুধবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় আড়াই বছর বয়সী শিশু মো. রাফিকে হত্যার ঘটনা ঘটে।

পুলিশ জানায়, গতকাল শুক্রবার বিকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিচারিক হাকিম তারান্নুম রাহাতের কাছে শ্বাসরোধ করে সন্তান হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন মা সেনোয়ারা বেগম (২৭)।

সেনোয়ারা বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ভেলানগর গ্রামে সৌদিপ্রবাসী ফারুক মিয়ার স্ত্রী। ১০ বছর আগে তাঁদের বিয়ে হয়। সেনোয়ারা একই উপজেলার রূপসদী গ্রামের সাগরি মিয়ার মেয়ে। এই দম্পতির ফাহিম (৬) ও রাফি নামে দুই সন্তানের জন্ম হয়।

স্থানীয় লোকজন ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত বুধবার (৩০ অক্টোবর) সকাল সাড়ে নয়টার দিকে রূপসদী গ্রামের একটি বিল থেকে শিশু রাফির লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই দিন শিশুটির দাদা আশ্রাফ জালালী বাদী হয়ে অজ্ঞাত নামা লোকজনকে আসামি করে থানায় একটি মামলা করেন। পরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পুলিশ সুপার পদোন্নতিপ্রাপ্ত) আলমগীর হোসেন ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (নবীনগর সার্কেল) মেহেদী হাসান ও বাঞ্ছারামপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহ উদ্দিন চৌধুরী মামলার তদন্ত শুরু করেন।

সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার জানান, বিয়ের পর সেনোয়ারা কিছুদিন শ্বশুরবাড়িতে ছিলেন। এরপর তাঁর স্বামী ফারুক ঢাকায় একটি দেশলাই তৈরির কারখানায় শ্রমিক হিসেবে যোগ দেন। সেনোয়ারা স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় চলে যান। তিন বছর আগে আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে ছয় লাখ টাকা ধার করে কারখানার কাজ ছেড়ে ফারুক সৌদি আরবে পাড়ি জমান। দুই সন্তান নিয়ে সেনোয়ারা বাবার বাড়িতে চলে আসেন। চাচা মরম আলীর ঘরে তিনি সন্তানদের নিয়ে থাকতেন।

ছোট ছেলে রাফি বিরল রোগে আক্রান্ত ছিল। কোথাও সামান্য আঘাত পেলে শরীরে রক্ত জমাট বেঁধে কালসিটে দাগ পড়ত। কোথাও কেটে গেলে রাফির ক্ষত স্থান দিয়ে অনবরত রক্ত ঝরত। এর জন্য সময়ে সময়ে রাফিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করা হতো। রাফির চিকিৎসার পেছনে কয়েক লাখ টাকা খরচ করা হয়েছে বলে দাবি করেছে পরিবারটি। প্রবাসী স্বামী সন্তানের চিকিৎসার খরচ ও সাংসারিক খরচ সামলাতে হিমশিম খেতেন। তিন বছরেও ধার করা টাকা সম্পূর্ণ পরিশোধ করতে পারেননি। এ নিয়ে চরম হতাশায় ভুগতেন সেনোয়ারা।

আদালতে দেওয়ার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মা সেনোয়ারা জানান, ২৯ অক্টোবর রাতের খাবার খেয়ে দুই সন্তান ফাহিম ও রাফিকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। দিবাগত রাত দুইটার দিকে রাফি ঘুম থেকে জেগে উঠে প্রস্রাব করবে বলে জানায় মাকে। সঙ্গে সঙ্গে আবার বলে প্রস্রাব করবে না। ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে রাফি আবার জেগে উঠে প্রস্রাব করবে বলে জানায়। রাফিকে প্রস্রাব করিয়ে কোলে নিয়ে বাড়ির পূর্বদিকে বাড়িয়াদহের বিলের দিকে রওনা হন মা সেনোয়ারা। বিলের পাড়ে পৌঁছে কোলে থাকা রাফির নাক, মুখ কিছু সময় চেপে ধরে রাখেন। রাফি মারা গেলে তিনি কচুরিপানার মধ্যে লাশ ছুড়ে ফেলেন। পরে বাড়ি এসে উঠানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। জ্ঞান ফিরলে রাফিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে চাচা মরম আলীসহ সবাইকে জানান।

পুলিশ সুপার বলেন, রাফির মায়ের আচরণ দেখে তাঁর ওপর পুলিশ নজর রাখা শুরু করে। সেনোয়ারার মধ্যে হতাশা দেখতে পাওয়া যায়। তবে কারও সঙ্গে সেনোয়ারার সম্পর্ক আছে কি না, পূর্বশত্রুতার জেরের বিষয়গুলো সামনে রেখে পুলিশ মামলাটি তদন্ত শুরু করে। সেনোয়ারা সুস্থ হলে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে।

পুলিশ সুপার বলেন, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অভাব ছিল মা সেনোয়ারার। হতাশা ও অন্যান্য সমস্যার কারণে তিনি নিজ সন্তানকে শ্বাসরোধ করে হত্যার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) আলমগীর হোসেন ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (নবীনগর সার্কেল) মেহেদী হাসান ও বিশেষ শাখার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ডিআইও-১) ইমতিয়াজ আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।