অজিতের পথচলা সুরের আলোয়

আসরে গানে মগ্ন অজিত জলদাশ। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে কালীপুর ইউনিয়নের জলদাশপাড়ায়।  প্রথম আলো
আসরে গানে মগ্ন অজিত জলদাশ। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে কালীপুর ইউনিয়নের জলদাশপাড়ায়। প্রথম আলো

চট্টগ্রামের বাঁশখালীর কালীপুরের বাড়িতে ঢুকতেই আঙিনাতেই পাওয়া গেল অজিত জলদাশকে (৫৫)। অলস বসে ছিলেন তিনি। পরিচয় দিতেই বসতে বললেন। গান শোনাতে বললে ভেতর থেকে পোশাক বদলে বেশ প্রস্তুতি নিয়েই বেরিয়ে এলেন। চোখে আলো নেই তাঁর। বাতাসে হাত বুলিয়ে সামনে রাখা হারমোনিয়াম খুঁজে নিলেন। তাঁরপর দরাজ গলায় শুরু করলেন গান। ‘মন পাখিরে বোঝাইলে সে বোঝে না’। আকুতি ভরা কণ্ঠ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী অজিতের। সুর যেন কেবল তাঁর কণ্ঠ চিরে নয়, বরং সারা শরীর থেকেই বেরিয়ে আসছে।

আট বছর বয়সে চোখ দুটো হারান চট্টগ্রামের বাঁশখালীর কালীপুরের জলদাশপাড়ার অজিত জলদাশ। সে বয়সেই ঢোলে হাতেখড়ি তাঁর। চোখে না দেখলেও শুনে শুনে অনুমান করে হারমোনিয়ামও বাজাতে শিখেছেন। ঢোল আর হারমোনিয়াম নির্ভুলভাবেই বাজান তিনি।

গান নিয়েই জীবন তাঁর। কালীপুর এলাকার লোকজন একনামেই চেনে তাঁকে। নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার ডাকও পড়ে। গান শুনিয়ে দিব্যি সংসারও চালান অজিত।

গানের ফাঁকে কথা হয় শিল্পী অজিতের সঙ্গে। জানালেন পাঁচ মেয়ে ও এক ছেলের সংসার তাঁর। স্ত্রী বেঁচে নেই। ভাঙা ঘর। বয়সও বেড়েছে। তাতে কী। জীবনযুদ্ধে হার মানতে নারাজ তিনি।

অজিত জলদাশ বলেন, ‘ আট বছর বয়সে গুটি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়েছিলাম। কারও কাছ থেকে শুনে মা জয়দিবালা দুচোখে পেঁয়াজের রস দেন। এরপর থেকে চোখ দুটো খারাপ হতে থাকে। চিকিৎসকের কাছে গেলেও টাকার অভাবে বেশি কিছু করতে পারিনি। এখন কোটরে চোখের কিছুই অবশিষ্ট নেই।’

তিনি আরও বলেন, তাঁর স্ত্রী বুলবুলি দাশ দুই বছর আগে অসুস্থ হয়ে মারা যান। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছোট ছেলে সনি দাশকে (১৯) চেষ্টা করছেন গান বাজনা শেখাতে। টাকার অভাবে ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা করাতে পারেননি। বাড়িটিও ঠিক করতে পারেননি। বর্ষায় ঘরে পানি ঢুকে সব ভিজে যায়।

সংসার কীভাবে চালাচ্ছেন জিজ্ঞেস করলে অজিত জলদাশ জানান, ধর্মীয় এবং বিয়ের অনুষ্ঠানে গান গেয়ে ও ঢোল বাজিয়ে এক থেকে দুই হাজার টাকা পান তিনি। প্রতিবন্ধী ভাতা পান ছয় মাসে ৪ হাজার ২০০ টাকা। এ দিয়ে কোনো মতে সংসার চলে।

অজিতের গানের কথা জানেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোমেনা আক্তারও। তিনি বলেন, ‘অজিত জলদাশকে আমি চিনি। তিনি ভালো গান করেন। প্রতিবন্ধী ভাতা পান। তাঁর জায়গা থাকলে সরকারিভাবে ঘর তৈরি করে দেওয়া হবে। জায়গা না থাকলে অন্যভাবে সহায়তা করা হবে।’

দারিদ্র্য আর শারীরিক কষ্ট অনেক সময় কাবু করে ফেলে অজিতকে। অজিত জানেন, এ জীবন বদলানোর নয়। পৃথিবীর রূপ–রং কখনো তাঁর দেখা হবে না। তবে সুরের ভেলায় তো ভাসতে পারেন তিনি। সুরের আলোতেই তাঁর পথ চলা। সে কারণেই অজিত আবার গান ধরেন। হারিয়ে যান নিজের সুরের ভেতর।