অকালে ঝরল ১১২ শিক্ষা জীবন

টাঙ্গাইলের সখীপুরে বাল্যবিবাহ, অসুস্থতা ও দারিদ্র্যের কারণে ৬৯ জন ছাত্রী এবং অল্প বয়সে রোজগারে নেমে পড়ায় ৪৩ জন ছাত্রসহ মোট ১১২ জন শিক্ষার্থী অকালেই শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়ল।

গতকাল শনিবার শুরু হওয়া চলতি বছরের জেএসসি (জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট) ও জেডিসি (জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট) পরীক্ষায় উপজেলার তিনটি কেন্দ্রের ছয়টি ভেন্যুতে ১১২ শিক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল। তাদের মধ্যে জেএসসিতে ৫৩ জন মেয়ে ও ২৭ জন ছেলে এবং জেডিসিতে ১৬ জন মেয়ে ও ১৬ জন ছেলে রয়েছে।

মেয়েদের বেলায় অল্প বয়সে বিয়ে, অসুস্থতা ও ছেলেদের রোজগারে নেমে পড়ার কারণে তারা শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়ল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, জেএসসি পরীক্ষায় উপজেলায় দুটি মূল কেন্দ্র ও তিনটি ভেন্যুতে ৪৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ৪ হাজার ২০ জন, জেডিসি পরীক্ষায় একটি কেন্দ্রে ২৭টি মাদ্রাসা থেকে ৮৪৮ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু জেএসসিতে ৮০ জন ও জেডিসিতে ৩২ জন পরীক্ষায় অনুপস্থিত থাকে।

এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে উপজেলার হামিদপুর গণ উচ্চবিদ্যালয়ের ৬ জন মেয়ে, আদর্শ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ৬, ঢনঢনিয়া নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৫, তক্তারচালা উচ্চবিদ্যালয়ের ৪ এবং বেতুয়া, হতেয়া, আড়াইপাড়া ও বড়চওনা উচ্চবিদ্যালয়ে ৩ জন করে মোট ১২ জন মেয়ে অনুপস্থিত রয়েছে। এ ছাড়া আরও কমপক্ষে ১৫টি উচ্চবিদ্যালয়ে একাধিক মেয়ে অনুপস্থিত ছিল।

হামিদপুর গণ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হারুনুর রশীদ বলেন, ছয়জন মেয়ের প্রবেশপত্র না নেওয়ার বিষয়ে এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, গোপনে তাদের পাঁচজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। একটি মেয়ে অসুস্থতাজনিত কারণে অংশ নেয়নি। আর আলহাজ নামের একটি ছেলে রোজগারের উদ্দেশে বিদেশে চলে গেছে।

বড়চওনা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লাল মিয়াও একই কারণ বর্ণনা করেন। সখীপুর পাইলট মডেল গভ. স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ও কেন্দ্রসচিব কে বি এম খলিলুর রহমান বলেন, মেয়েদের অনুপস্থিতির কারণ বাল্যবিবাহ। আর ছেলেদের অনেকেই বয়স বাড়িয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। কেউবা রোজগারের উদ্দেশ্যে নানা কাজে যোগ দিয়েছে।

ঘেচুয়া-বড়চালা নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের চারজন ছেলে, কালমেঘা উচ্চবিদ্যালয়ের তিন এবং সূর্যতরুণ, ঢনঢনিয়া নিম্নমাধ্যমিক ও বহেড়াতৈল উচ্চবিদ্যালয়ে তিনজন করে ছেলে পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত রয়েছে।

ঘেচুয়া-বড়চালা নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমিনুল ইসলাম বলেন, তাঁর বিদ্যালয়ের চারটি ছেলের পরিবারে সচ্ছলতা না থাকায় তারা রোজগারের উদ্দেশে রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজে যোগ দিয়েছে। শিক্ষাজীবন থেকে অকালে ঝরে গেল চারটি জীবন।

সূর্যতরুণ শিক্ষাঙ্গন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবু নাসের ফারুক জানান, তাঁর বিদ্যালয়ের দুটি ছেলে খুবই দরিদ্র। তাদের একজন অসুস্থতাজনিত কারণে এবং অপরজন রডমিস্ত্রির কাজে যোগ দেওয়ায় পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি।

এদিকে জেডিসি পরীক্ষায় ১৬ জন মেয়ে ও ১৬ জন ছেলে অনুপস্থিতির বিষয়ে মাদ্রাসা কেন্দ্রের সচিব কালিদাস দাখিল মাদ্রাসার সুপার হাবিবুর রহমান বলেন, তিনি খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, মেয়েরা বাল্যবিবাহ ও ছেলেদের কিছু কাজে যোগদান, অসুস্থতা আর কিছু ছাত্র কওমি মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়ার কারণে পরীক্ষায় অংশ নেয়নি।

বিষয়টি নিয়ে একাধিক অভিভাবকের সঙ্গে কথা হয়। অভিভাবক জুলহাস উদ্দিন বলেন, তাঁর ছেলে পাড়ার বখাটে ছেলেদের সঙ্গে মিশে মাদকে আসক্ত হওয়ার উপক্রম হয়। কোনো কূলকিনারা না পেয়ে ছেলের বয়স বাড়িয়ে পাসপোর্ট করে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এ কারণে সে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি।

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মফিজুল ইসলাম বলেন, সখীপুরে আগে থেকেই শিক্ষার হার কম। অনগ্রসরতা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অসচেতনতা, বাল্যবিবাহ ইত্যাদির কারণেই এ ঝরে পড়া। এটা রোধ করতে হলে শিক্ষার হার বাড়াতে ও সবাইকে সচেতন হতে হবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আমিনুর রহমান জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষায় ১১২ জন শিক্ষার্থী অকালেই ঝরে যাওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন।